যে তামিল গেরিলাদের দমন করে শ্রীলংকার ‘লৌহমানব’ উপাধি পেয়েছিলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে, পুনরায় ক্ষমতায় আসতে এবার তাদেরকেই হাতিয়ার বানাচ্ছেন তিনি।
সংখ্যালঘু তামিলদের ওপর হত্যা, গুম, কারা-নির্যাতন চালানো সেই রাজাপাকসে এবার ক্ষমতার স্বার্থে তামিল বিদ্রোহীদের মুক্তি দিতেও রাজি। বিনিময়ে পার্লামেন্টে তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (টিএনএ) এমপিদের সমর্থন চান ‘নতুন প্রধানমন্ত্রী’ রাজাপাকসে। যেন আসন্ন অনাস্থা ভোটে তার আস্থার পাল্লা ভারী হয়।
জেলবন্দি তামিলদের মুক্তির দীর্ঘদিনের দাবি শিগগিরই পূরণ হতে যাচ্ছে বলে শনিবার টুইটারে জানিয়েছেন রাজাপাকসের ছেলে নামাল রাজাপাকসে।
তবে রাজাপাকসের ‘গদি দখলের’ এ কূটমন্ত্রে মন গলছে না উত্তর-পূর্বের ‘পোড় খাওয়া’ তামিলদের। রাজাপাকসেতে তাদের বিশ্বাস নেই।
পাকসে বংশধরের টুইটের ঠিক পরদিনই নিজেদের কঠোর অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করল তামিলরা। পার্লামেন্টে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জোরালো ঘোষণা দিলেন সংখ্যালঘু তামিল এমপিরা।
১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিরতিহীন বিদ্রোহ শুরু করে লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই)। তারা তামিল টাইগার নামে পরিচিত। দ্বীপরাষ্ট্রের উত্তর ও পূর্ব অংশ নিয়ে তামিল ইলম নামে স্বাধীন তামিল রাষ্ট্র গঠনের লড়াই ছিল এটি।
শুরু থেকেই তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালায় শ্রীলংকার সেনাবাহিনী। দীর্ঘ ২৬ বছর পর ২০০৯ সালের মে মাসে তামিল টাইগারদেরকে পরাজিত করে সেনাবাহিনী। সমাপ্তি ঘটে প্রায় তিন দশকের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের। এ গৃহযুদ্ধে প্রায় ১ লাখ মানুষ নিহত হন। হত্যা করা হয় এলটিটিই প্রতিষ্ঠাতা নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণকে। লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি আরেক নেতা পট্টু আমানের। গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার এলটিটিই সদস্যকে।
২০০২ সালে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় তামিল টাইগারদের সঙ্গে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ২০০৫ সালে ক্ষমতায় এসে রাজাপাকসে তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যায়। ২০০৬ সালের জুলাই থেকে ধারাবাহিক অভিযান শুরু করেন রাজাপাকসে।
বন্দি করা হয় প্রায় ২০ হাজার তামিল টাইগার সদস্যকে। অসংখ্য তামিলদের গুম করা হয়। কারাগারে নির্যাতন চালিয়ে ৮৫ তামিল টাইগারকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে। অর্ধশতাধিক তামিল নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে বারবার যুদ্ধাপারাধের অভিযোগ তোলা হলেও কোনো লাভ হয়নি। রাজাপাকসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনে গুম-হত্যার শিকার তামিল পরিবারগুলো ফের শঙ্কিত। রোববার শ্রীলংকা গার্ডিয়ানকে গুম হওয়া এক তামিল টাইগারের মা বলেন, ভয়ে শরীরের লোম এখনও খাঁড়া হয়ে ওঠে।
কারাবন্দি তামিল টাইগারদের সিংহভাগই পুনর্বাসনের জন্য মুক্তি পেয়েছে। বর্তমানে দুই শতাধিক তামিল টাইগার শ্রীলংকার জেলে বন্দি রয়েছে। তারা ৮ থেকে ১৫ বছর ধরে কারাবন্দি। জেলে আটক এসব তালিমকে মুক্তি দিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী বহুবার প্রেসিডেন্টকে আর্জি জানিয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো ফল আসেনি।
এবার ক্ষমতার ফায়দা হাসিলে তাদেরকেই রাজনীতির হাতিয়ার বানানোর ছক কষছেন রাজাপাকসে। তামিল ভাষায় এক টুইট বার্তায় রাজাপাকসের ছেলে এমপি নামাল বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রাজাপাকসে তামিলদের মুক্তির বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
শ্রীলংকার পার্লামেন্টের ২২৫ আসনের মধ্যে রাজাপাকসে-সিরিসেনার দলের ৯৬ জন সংসদ সদস্য আছেন। পক্ষত্যাগের কারণে সেই সংখ্যা এখন ১০০। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তাদের আরও ১৩ সংসদ সদস্য দরকার। বিক্রমাসিংহের রয়েছে ১০৩ এমপির সমর্থন। বাকি ২২ এমপির মধ্যে তামিল জোটের রয়েছে ১৬ সংসদ সদস্য।
তাদের মধ্যে চার এমপি পক্ষত্যাগ করে রাজাপাকসেকে সমর্থন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বাকিরা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে একাট্টা। দেশটির সংখ্যালঘু তামিল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক জোটটি জানিয়েছে, ‘সংবিধানের ১৯০তম সংশোধনী লঙ্ঘন করেই রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
পার্লামেন্টে তারা রাজাপাকসের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবে।’ এতেই স্পষ্ট যে তামিলরা বহিষ্কৃত প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন দেবেন।
বিডি-প্রতিদিন/৫ নভেম্বর ২০১৮/আবুল কালাম