ভারতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের প্রতিমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটি মন্তব্য করায় বিতর্কের ঝড় উঠেছে। মন্ত্রী ডা. সুভাষ সরকার রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেন, কবির গায়ের রঙ কালো ছিল বলে তার মা তাকে কোলে নিতেন না।
ঠাকুর পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী বা সাহিত্যিক সকলেই বলছেন তার গায়ের রঙ কিছুটা চাপা ছিল ঠিকই, কিন্তু মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন, এরকম কোনও তথ্য পাওয়া যায় না।
এই প্রসঙ্গ একেবারেই অনভিপ্রেত বলে তারা মনে করছেন। তবে এই বিতর্কে মন্ত্রীর পাশেই দাঁড়িয়েছে তার দল ক্ষমতাসীন বিজেপি।
সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভায় নিযুক্ত হয়ে কেন্দ্র শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন ডা. সুভাষ সরকার। মন্ত্রীর একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
কী বলছেন ঠাকুর পরিবারের সদস্য?
ওই ক্লিপে ডা. সুভাষ সরকারকে বলতে শোনা গেছে, “তার মা এবং তার বাড়ির অনেকে, রবীন্দ্রনাথ কালো বলে তাকে কোলে নিতেন না। সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষের হয়ে বিশ্বজয় করেছেন।”
ওই ক্লিপে ডা. সুভাষ সরকার বিস্তারিতভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গায়ের রং প্রসঙ্গে বলেছেন।
যদিও এটা স্পষ্ট নয় যে কেন তিনি রবীন্দ্রনাথের গায়ের রঙের প্রসঙ্গ এনেছিলেন, কারণ গোটা ভাষণটি শোনা যায়নি।
তবে ঠাকুর পরিবারের সদস্য এবং শান্তিনিকেতনের প্রবীণ আশ্রমিক সুপ্রিয় ঠাকুরের কথায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গায়ের রঙ একটু চাপা ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই প্রসঙ্গে মন্তব্য করা একেবারেই অনভিপ্রেত।
“এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা না হলেই ভাল ছিল। এটা কেন তিনি বললেন, তিনিই জানেন। আমি যেটা শুনেছি, যে রবীন্দ্রনাথের গায়ের রঙ অন্যান্য ভাইদের তুলনায় একটু চাপা ছিল। সেটা নিয়ে ওর মায়ের ক্ষোভ ছিল একটা। কিন্তু সেটা নিয়ে এরকম মন্তব্য করার কোনও মানে আছে বলে আমি মনে করি না,” বলেন সুপ্রিয় ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন?
ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্যের আরেকটি দিক ছিল, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা তাকে কোলে নিতেন না - অর্থাৎ মাতৃস্নেহ থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন।
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই তথ্য সঠিক নয়।
শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র ও প্রবীণ সাংবাদিক- লেখক রজত রায় বলছেন এরকম কোনও তথ্য তিনি পাননি কোথাও।
“এটা আমি কোথাও পাইনি যে রবীন্দ্রনাথ মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের দুটি বইয়ে উল্লেখ আছে যে মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন ছিল। একটি জীবনস্মৃতি, দ্বিতীয় বইটি ছেলেবেলা। সেখানে এরকম কোনও ঘটনার উল্লেখ নেই যা থেকে মনে হতে পারে যে মাতৃস্নেহ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন,” বলেন রজত রায়।
“উল্টোটাই বরং আছে। তার মা বালক রবীন্দ্রনাথকে ডেকে বলতেন যে রামায়ণ, মহাভারতের মতো ধর্মগ্রন্থ পড়ে শোনাতে। রবীন্দ্রনাথ খুব উৎসাহের সঙ্গে মা এবং মায়ের বয়সী অন্যদের সামনে দুপুরবেলা সেগুলো পড়তেন। আরও উল্লেখ আছে, বাড়িতে মাস্টারমশাইদের কাছে পড়তে হত খুব কড়া নিয়মে। তাদের এড়াবার জন্য অনেক সময়েই রবীন্দ্রনাথ মায়ের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতেন এবং মা সেটাকে প্রশ্রয় দিতেন।”
“মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হলে এগুলো পাওয়া যায় না,” মন্তব্য রজত রায়ের।
‘রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মন্তব্যের আগে তার জীবনী পড়া উচিত’
কবি ও সাহিত্যিক তিলোত্তমা মজুমদার বলছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কোনও কথা বলার আগে সহজেই উপলব্ধ রবীন্দ্র জীবনী পড়ে নেওয়া উচিত, যাতে কোনও ভুল ভ্রান্তি না হয় এবং একজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দায়টা আরও বেশি।
“যেহেতু সবিস্তার রবীন্দ্র-জীবনী এখনও সহজলভ্য, যে কেউ চাইলেই পড়ে, দেখে মিলিয়ে নিতে পারেন। তাই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কোনও কথা বলার আগে একবার রবীন্দ্র জীবনী পড়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ যার সম্পর্কে তথ্য রয়েছে, তার সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে সেটা অভ্রান্ত হওয়াই বাঞ্ছনীয় এবং যিনি বলছেন, তিনি যেহেতু একজন মান্যগণ্য (ব্যক্তি), তাই তার দায়িত্বটাও অনেক থাকে।”
‘মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথকে ছোট করতে চান নি’: বিজেপি
ডা. সুভাষ সরকারের পাশেই অবশ্য দাঁড়িয়েছে তার দল বিজেপি। তাদের দাবি ডা. সরকার কখনই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে হেয় করার জন্য ওই কথাগুলো বলেননি।
পশ্চিমবঙ্গে দলটির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়," ডা. সুভাষ সরকার একটা নির্দিষ্ট বিষয় উদ্ধৃত করেছেন। এর অর্থ এই নয় যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে ছোট করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো লিখে গেছেন যে তার গায়ের রঙ ছিল চাপা।"
“রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুর পরিবার নিয়ে অজস্র বই আছে, দলিল আছে। সেরকমই কোনও বইতে পড়ে হয়তো সহজ সরল মনে তিনি কথাটা বলেছেন। এটা একটা নন ইস্যুকে ইস্যু বানাতে চাইছেন, অহেতুক একটা রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করতে চাইছেন,” বলেন শমীক ভট্টাচার্য।
শুধু এই একটি ঘটনা নয়। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নিযুক্তির পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের ভাবধারার বিপরীতে তার প্রতিষ্ঠানটি চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অধ্যাপক চক্রবর্তী বিজেপির কাছের লোক বলেই পরিচিত।
তার কাজ এবং কথাবার্তা নিয়ে বারে বারেই সমালোচনা হচ্ছে।
কখনও উন্মুক্ত প্রান্তরের বিশ্বভারতীতে পাঁচিল লাগানো, কখনও সরাসরি বিজেপি নেতাদের নিয়ে সেমিনার আয়োজন, কখনও বা সঙ্গীত ভবনের অধ্যাপকদের অনুষ্ঠান করতে না দেওয়া - উপাচার্যের কাজের সমালোচনার তালিকা ক্রমশই দীর্ঘ হচ্ছে এমন একটা বছরে, যেটা রবীন্দ্রনাথের তৈরি এই প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ।
বিডি প্রতিদিন/কালাম