রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে নতুন অস্ত্রের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার যুদ্ধ–সক্ষমতাকে হ্রাস করার জন্য সামরিক উপায়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক পদক্ষেপও নিয়ে চলেছে। এর ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া হলো গত সপ্তাহে। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানি তেলের সর্বনিম্ন দর বেঁধে দিয়ে বলেছে, কোনো দেশই এর নিচে রাশিয়া থেকে তেল কিনতে পারবে না। এ ছাড়া রাশিয়া থেকে সমুদ্রপথে তেল আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপ।
বেঁধে দেওয়া দামে রাশিয়ার তেল বিক্রি নিশ্চিতের জন্য ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে ব্যবহার করছে পশ্চিমা দেশগুলো। সমুদ্রপথে তেলবাহী জাহাজ চলাচলে বিমা-সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর আধিপত্য রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কম দামে তেল কেনা হলে তেলবাহী ট্যাংকারগুলোকে বিমা-সুবিধা দেওয়া হবে না। রাশিয়ার তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার এ সিদ্ধান্তের প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। কৃষ্ণসাগর থেকে আসা বসফরাস প্রণালিতে অপেক্ষমাণ জাহাজগুলোকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার আগে সেগুলোর বিমা করা আছে কি না, সেটা যাচাই শুরু করেছে তুরস্ক। অন্য অনেক দেশের মতো তুরস্কও চায় না তাদের সীমানা দিয়ে অবিমাকৃত কোনো তেলের জাহাজ পার হয়ে যাক। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে এবং সমুদ্রে তেল ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা পরিষ্কার করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আন্তসংযোগকে যেভাবে সামনে নিয়ে এসেছে, সাম্প্রতিক অতীতে এমন নজির দেখা যায়নি।
গত আট মাসের যে বাস্তবতা, তাতে রাশিয়ার তেল রপ্তানির ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানামুখী নিষেধাজ্ঞার পরও যুদ্ধপূর্ব সময়ের তুলনায় রাশিয়ার তেল রপ্তানি মাত্র ৫ শতাংশ কমেছে। অনেক দেশই আছে, যারা সানন্দে রাশিয়ার তেল কিনছে। এ প্রেক্ষাপটে তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা কার্যকর একটা ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সতর্কতাও প্রয়োজন। পশ্চিমা দেশগুলো দ্বিমুখী সংকটে পড়েছে। রাশিয়াকে শক্ত করে ধরতে গেলে পশ্চিমা ও মিত্রদেশগুলোকে অসহনীয় অর্থনৈতিক দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে। আবার নরম পদক্ষেপ নিলে রাশিয়া যুদ্ধের গতি বাড়ানোর মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করে ফেলবে।
তেলের দাম বেঁধে দেওয়ার দৃষ্টান্তটি বিবেচনায় নেওয়া যাক। এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে জি-৭ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের কয়েক সপ্তাহ লেগে গেছে। শেষে রাশিয়ার তেলের সর্বনিম্ন দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে প্রতি ব্যারেল ৬০ মার্কিন ডলার। কমবেশি এ দামেই রাশিয়ার তেল এখন বিশ্ববাজারে বিক্রি হচ্ছে। ইউক্রেনের দাবি ছিল প্রতি ব্যারেলের দাম যেন ৩০ ডলারের নিচে বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর শঙ্কা হচ্ছে, এত কম দাম নির্ধারণ করা হলে রাশিয়া তেল উত্তোলন বন্ধ করে দেবে। এতে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যেমন আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, ঠিক তেমনি মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়া ছুটতে শুরু করবে।
রাশিয়ার তেলের দাম ৬০ ডলারে নির্ধারণ করার ব্যাপারটি সরাসরিভাবে রাজনৈতিক একটা সিদ্ধান্ত। বাজারদরের কাছাকাছি একটা দর বেছে নেওয়ার মানে হচ্ছে পশ্চিমারা রাশিয়াকে কাবু করার নীতি নিল ঠিকই, কিন্তু পশ্চিমা অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হতে পারে, সে বিবেচনায় এখনই জোর করে চেপে ধরছে না। কিন্তু একবার নীতি যখন নেওয়া হলো, তখন ভবিষ্যতে শক্তভাবেই তার প্রয়োগের অস্ত্র পশ্চিমাদের হাতে থাকল। কিন্তু এই জুয়া খেলার মূল্য পরিশোধ করতেই হবে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া তেল উৎপাদন হ্রাসের চিন্তা করছে, যেটি পশ্চিমা অর্থনীতিতে নতুন করে আঘাত করবে। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নতুন এই তেল-অস্ত্রে বড় একটি সমস্যা রয়েছে। এর প্রভাব কী হবে, তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো খুব মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করছে।
ওপেক বা তেল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে আরব ও আফ্রিকার ১৩টি দেশ রয়েছে। এদের মধ্যে লিবিয়া, ইরাক, ইরানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে পশ্চিমের সম্পর্ক ভালো নয়। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর নতুন তেল-অস্ত্র যদি কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ওপেক সদস্যদের বিরুদ্ধে এটা প্রয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
ওপেকের সদস্যদেশগুলো পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা মূল্যায়ন করে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে চাইছে। পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে তেলের বড় ক্রেতা চীন ও ভারত কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেদিকেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন তাকিয়ে আছে। সূত্র: এশিয়া টাইমসের ইংরেজি কলাম অনূদিত, লেখক: ফয়সাল আল ইয়াফি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল