ইসলাম যে কয়েকটি বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সেগুলোর অন্যতম। মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে এমন সব কাজকে ইসলামে অবৈধ ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রশান্তচিত্তে মানুষ জীবন কাটাবে, যাপিত জীবনে নির্বিঘ্নে আপন রবের ইবাদত করে যাবে, এমনটাই ইসলামের শিক্ষা।
মানুষ সম্মানিত প্রাণী : কোরআন মাজিদের ভাষায় মানবজাতি মর্যাদাশীল প্রাণী। আল্লাহ মানবজাতিকে সম্মানিত করেছেন। উত্তম রিজিক দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির মাঝে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্ব। ইরশাদ হয়েছে- ‘বাস্তবিক পক্ষে আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদের উত্তম রিজিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল-৭০)
অন্যায় হত্যাকাণ্ড হারাম ও কুফরতুল্য : অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা অত্যন্ত ভয়াবহ গুনাহগুলোর অন্যতম। কোরআন মাজিদে স্পষ্ট ভাষায় অন্যায় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ যেই প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে হত্যা করো না, তবে (শরিয়ত অনুযায়ী) তোমরা তার অধিকার লাভ করলে ভিন্ন কথা। যাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, আমি তার অলিকে (কিসাস গ্রহণের) অধিকার দিয়েছি। সুতরাং সে যেন হত্যাকার্যে সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয়ই সে এর উপযুক্ত যে তার সাহায্য করা হবে। (বনি ইসরাইল-৩৩)
সুরাতুল ফুরকানে শিরকের মতো ভয়াবহ গুনাহের উল্লেখের পরপরই অন্যায় হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় অন্যায় হত্যাকাণ্ড কুফর-শিরকের কাছাকাছি ভয়াবহ কবিরা গুনাহ। ইরশাদ হয়েছে এবং যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। যে ব্যক্তিই এরূপ করবে তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে। (আল ফুরকান-৬৮)
ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতি :
ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। চিরস্থায়ী শাস্তির হুঁশিয়ারি রয়েছে এ ক্ষেত্রে। রয়েছে আল্লাহর গজব ও লানতের ধমকিবাণী। ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে জেনেশুনে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি গজব নাজিল করবেন ও তাকে লানত করবেন। আর আল্লাহ তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। (আন নিসা-৯৩)
যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করল :
ইসলামে জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কোনো একজন ব্যক্তির জীবন বিপন্ন হলে, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা হলো। কোরআন মাজিদে স্পষ্ট ভাষায় এ হুঁশিয়ারি প্রদান করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি বনি ইসরাইলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম, কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারও প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল। বস্তুত আমার রসুলগণ তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি নিয়ে এসেছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে বহু লোক পৃথিবীতে সীমা লঙ্ঘনই করে যেতে থাকে।’ (আল মায়িদাহ-৩২)
ভয়াবহ কবিরা গুনাহগুলোর অন্যতম : অন্যায় হত্যাকাণ্ড ভয়াবহ কবিরা গুনাহগুলোর অন্যতম। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবিরা গুনাহের বিবরণ দিতে গিয়ে শিরক পরপরই অন্যায় হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করে উম্মতকে সতর্ক করেছেন।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা, প্রাণ হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া আর মিথ্যা বলা, কিংবা বলেছেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। (সহিহ বুখারি-৬৮৭১)
একজন মুমিনের মর্যাদা
একজন মুমিনের মর্যাদা আল্লাহর কাছে পুরো দুনিয়ার চেয়েও বেশি। পুরো দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও একজন মুমিনের হত্যাকাণ্ড আল্লাহর কাছে গুরুতর।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করা আল্লাহর কাছে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও গুরুতর। (সুনানে আন-নাসায়ী- ৩৯৮৮)
পত্রিকার খুললেই খুনাখুনি আর হত্যাকাণ্ডের সংবাদে মনটা বিমর্ষ হয়ে ওঠে। সবকিছুর দাম বাড়লেও মানুষের জীবনের দাম যেন দিন দিন কমে যাচ্ছে। একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকছে। এমতাবস্থায় সুখময় নিরাপদ জীবনযাপন করতে ইসলামি অনুশাসনের যথার্থ অনুশীলনের বিকল্প নেই। সবাই আপন আপন জায়গা থেকে শরিয়াহর যথার্থ অনুশীলনের চেষ্টা চালাই। আল্লাহ তওফিক দান করুন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম টঙ্গী, গাজীপুর। খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর
বিডি প্রতিদিন/এমআই