নেতা ভালো হলে দেশ ভালো হয়ে যায়। নেতা খারাপ হলে সে দেশ কখনো এগোতে পারে না। ভালো নেতা কাকে বলে? যিনি সব ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রাখেন তিনিই ভালো নেতা। হাদিস শরিফে রাসুল (সা.) সাত ব্যক্তির ব্যাপারে বলেছেন—যাঁরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় থাকবেন, তাঁদের প্রথমজন হলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক বা ভালো নেতা।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) কোরআন-হাদিস নিংড়ে ভালো নেতার গুণাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, নেতার জন্য প্রথম ফরজ হলো নিরপেক্ষ হওয়া। তার অধীনে প্রশাসনিক যত কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হবে সবাই যেন নিরপেক্ষ থাকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করাও নেতার প্রথম ফরজ কাজ। নেতাকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, কোনোভাবেই যেন দল-গোষ্ঠী কিংবা মত বিবেচনায় প্রশাসক নিয়োগ না দেওয়া হয়; বরং প্রশাসক নিয়োগ হবে আল্লাহভীরুতা, জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে।
আর এসব কিছুর ক্ষেত্রে সততা হবে প্রধান পলিসি। এ ব্যাপারটি যদি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে অতিদ্রুতই হারিয়ে যাওয়া নৈতিকতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ ফিরে আসবে।
তবে শতভাগ আন্তরিক চেষ্টার পরও যদি কোথাও কোনো ভুল থেকে যায়, তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ সে ভুল ক্ষমা করে দেবেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘ওহে বিশ্বাসীরা! তোমাদের সাধ্যমতো আল্লাহকে ভয় করো।’
(সুরা : তাগাবুন, আয়াত : ১৬)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কারো সাধ্যের বাইরে কোনো দায়িত্ব আল্লাহ চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮৬)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কোনো কাজের নির্দেশ দিলে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে করবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ইসলামের চাওয়া হলো, সব মানুষকে সমান হিসেবে বিবেচনা করা। আদম সন্তান সবাই সমান। এখানে ধনী-গরিব, মেধাবী-মেধাহীন, শক্তিশালী-দুর্বল, মালিক-শ্রমিক—এসব বিবেচনায় মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় না; বরং সবাই আল্লাহর বান্দা।
পদ-পদবির কারণে কারো মর্যাদা বেশি-কম করার সুযোগ নেই; বরং যার তাকওয়া বেশি সে-ই সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাবান মানুষ হবে। যখন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে নিরপেক্ষ ও সততার ভিত্তিতে দায়িত্ব পালন করা হবে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সব মানুষকে সমান বিবেচনা করে সমান সেবা দেওয়া হবে। সেখানে কেউ তদবিরের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে না। সরকারি সেবার জন্য সাধারণ মানুষকে ঘুষের আশ্রয় নিতে হবে না। বাজারে কোনো সিন্ডিকেট থাকবে না। ভেজাল ব্যবসা অটো বন্ধ হয়ে যাবে।
মনে রাখতে হবে, সততা আগে নিজের থেকে আসে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা মনে করি, ওপরে-নিচে সবাই অসৎ, আমি সৎ হয়ে কী উদ্ধার করব? এমন চিন্তা সঠিক নয়। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব, তুমি আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করো। তুমি শুধু তোমার নিজের ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করো। আশা করা যায়, আল্লাহ অচিরেই কাফিরদের শক্তি প্রতিহত করবেন। আর আল্লাহ শক্তিতে প্রবলতর এবং শাস্তিদানে কঠোরতর।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৪)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ওহে বিশ্বাসীরা! তোমরা নিজেদের মুক্তির কথা ভাবো। তোমরা যদি সততার পথে থাকো তাহলে অসৎ ব্যক্তিরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
(সুরা : মায়িদা, আয়াত : ১০৫)
সব মানুষকে সমান বিবেচনার পর রাষ্ট্রের দ্বিতীয় কাজ হবে ক্ষুধা ও দরিদ্রতা দূর করা। দ্বিতীয় খলিফা ওরম (রা.) যখন খিলাফতের দায়িত্ব নিলেন, তিনি রাতের পর রাত মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে খোঁজ নিতেন কারো কোনো অভাব-অনটন আছে কি না জানার জন্য। তিনি রাতে বের হয়ে কাঁদতেন আর বলতেন, ফুরাতের তীরে একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, তাহলে আমাকে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। যখন মানুষের ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে, তখন ধীরে ধীরে অন্য মৌলিক অধিকারগুলোও পূরণ হতে থাকবে। আর আল্লাহর দুয়ার দেশবাসীর জন্য খুলে দেওয়া হবে। তখন দেশ প্রাকৃতিক সম্পদের আধারে পরিণত হবে। আল্লাহ বলেন, ‘জনপদবাসী যদি মুমিন ও খোদাভীরু হতো এবং সততার নীতি অবলম্বন করে জীবন পরিচালনা করত, তবে তাদের জন্য আমি আকাশ ও পৃথিবীর সব কল্যাণের দরজা খুলে দিতাম।’
(সুরা : আরাফ, আয়াত : ৯৭)
লেখক : চেয়ারম্যান, জামালী তালিমুল কোরআন ফাউন্ডেশন
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন