তিনি না থাকলে বাংলাদেশের সাথে কোনদিনই ছিটমহল সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো না বলে নিজেই এই দাবি করেছেন মমতা ব্যানার্জি। বৃহস্পতিবার বিকালে রাজ্যটির কোচবিহার জেলার মাথাভাঙায় নির্বাচনী প্রচারণায় উপস্থিত থেকে মমতা বলেন, ‘৭০ বছরের ছিটমহল সমস্যা-আমরাই জমি দিয়েছি, আমরাই ছিটমহল সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি। অন্য সরকার করেনি, না করেছে কংগ্রেস সরকার, না করেছে সিপিআইএম সরকার, না করেছে বিজেপি সরকার। আর এক্সপায়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদি বাবুকে জিজ্ঞাসা করুন মমতা ব্যানার্জি না থাকলে ওই ছিটমহল সমাধান থোড়াই হতো! এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করেছে বাংলাদেশের সাথে...ভারত সরকারকে রাখতে হয় তাই রেখেছে...কারণ বাংলা ভারতের একটা অংশ...তাই একসাথে করেছি। ওদের উন্নয়নের জন্য ১১০০ কোটি রুপি দিয়েছি। জমির অধিকার দেওয়া হয়েছে।’
এর আগে গতকাল বুধবার রাজ্যটির শিলিগুড়িতে নির্বাচনী প্রচারণা থেকে মমতাকে ‘স্পিড-ব্রেকার’ বলে কটাক্ষ করে নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ করেছিলেন স্পিড-ব্রেকার দিদির কারণেই বাংলার উন্নয়ন স্তব্ধ হয়ে গেছে, দিদি এ রাজ্যের জন্য কিছুই করেননি, গরীবদের তিনি দাবিয়ে রাখতে চান।
মোদির ওই মন্তব্যের পরই ওই দিন বিকালেই কোচবিহার জেলার দিনহাটার জনসভা থেকে তার কড়া জবাব দিলেন মমতা। চব্বিশ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সেই কোচবিহারের (মাথাভাঙা) মাটি থেকেই নতুন করে মোদিকে নিশানা করেন মমতা। বাংলায় নিজের সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে মমতা জানান, তার জন্যই আজ ছিটমহলের সমাধান হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশলী কলেজ, মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ, বেকার ছেলেদের জন্য কর্মতীর্থ, আটিআই, কৃষক মান্ডি-সবকিছুই আমাদের মা-মাটি-মানুষের সরকার করেছে।’
কেন্দ্রের মোদি সরকারকে তোপ দেগে মমতা বলেন, ‘মোদি বাবু চাওয়ালা বলে সকলের চাকরি খেয়ে নিয়েছে। আর আমরা সবাইকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। পাঁচ বছর আগে মোদি বাবু যখন ক্ষমতায় আসেন তিনি বলেছিলেন চাওয়ালা হ্যায়-আর এবার চাওয়ালা হয়ে গেছেন চৌকিদার-তার কেটলিও নাই, চাও নেই, চিনিও নেই। অতএব ভাওতা প্রমাণ হয়ে গেছে। মিথ্যা ছাড়া তিনি একটাও সত্যি কথা বলেন না।’
মমতার অভিযোগ, এই প্রথম আমি দেখছি যে নির্বাচনের নামে একজনের কাছ থেকে কোটি কোটি রুপি পাওয়া যাচ্ছে। এটা দেশের পক্ষে বড় কুৎসা। মমতার প্রশ্ন, ওরা রুপি ছড়িয়ে ভোট কিনবে? মানুষ যখন খেতে পায় না তখন খেতে দাও? একটা ওষুধ কিনে দিয়েছ কোনদিনও? একটা বই কিনে দিয়েছ? কারও মেয়ের বিয়ে দিয়েছ? কিছুই করেনি। ১৫ লাখ রুপি ব্যাংকে ফেরত দেওয়া হবে বলেও তা হয়নি। কৃষক আত্মহত্যা করছে, গত ৪৫ বছরে এই সরকারের আমলেই দেশে বেকারত্ব সর্বোচ্চ বেড়েছে। গোরক্ষকের নাম করে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। আর যখন নির্বাচন এসেছে তখন আবার ধোকা দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) নিয়েও এদিন কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছেন মমতা। তার স্পষ্ট জবাব এরাজ্যে কোনভাবেই এনআরসি চালু করতে দেওয়া হবে না। মমতা বলেন, ‘এনআরসি-এর নাম করে ২২ লাখ হিন্দু বাঙালি ও ২৩ লাখ মুসলিমদের নাম বাদ দিয়েছে। আবার গর্ব করে তারা বলছে বাংলায় বিজেপি জিতলে এখান থেকেও সবাইকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। আমরা বলছি গতবার দুইটি আসন ছিল, এবার একটা আসনও পাবে না। বাংলায় এনআরসি কোন দিনই করতে দেব না।’ নাগরিকত্ব বিল নিয়েও কেন্দ্র ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ মমতার। তাঁর অভিযোগ দাঙ্গা করে বিজেপির সারা শরীরে রক্ত লেগে আছে। মানুষকে খুন করা রক্ত নিয়ে কি করে উনি প্রধানমন্ত্রী হলেন ঈশ্বর জানেন।’
বিজেপির তরফে যতই দাবি করা হোক যে এবারও তারা কেন্দ্রে সরকার গঠন করবে-বিজেপির সেই যু্িক্ত উড়িয়ে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এই সভা থেকে বলেন, ‘মোদিবাবুকে যতই চেষ্টা করা হোক..ওঁর এক্সপায়ারি ডেট ওভার হয়ে গেছে। ওই ওষুধ আর কাজে লাগবে না। কি করে জিতবে? উত্তরপ্রদেশে গত নির্বাচনে ৮০ টার মধ্যে ৭৩ টা পেয়েছিল কিন্তু এবার সর্বোচ্চ ২৫টা পাবে। অর্থাৎ এক ধাক্কায় অর্ধশতাধিক আসন কমে গেল। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় মিলিয়ে গত নির্বাচনে ৬০ ছিল এবার খুব বেশি হলেও ৩০ টা পাবে। দক্ষিণ ভারত, গুজরাট, অন্দ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়–, ওড়িষ্যা, বাংলা-সব মিলিয়ে ১৯১ টা আসনের মধ্যে ভাল সময়ে তারা ২১ আসন পেয়েছিল আর এবার যদি ২৫ টাও পায় সরকার গঠন করতে পারবে? অতএব গোটা দেশে ৫৪৩ টি আসনের মধ্যে ১৪১ টা পেলেও ভাববেন যে ওদের অনেক বড় ভাগ্য।’
বুধবার দিনহাটা সভায় প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে মুখ্যমন্ত্রী যেখানে থেমেছিলেন-বৃহস্পতিবার ঠিক যেন সেখান থেকেই শুরু করলেন মুখ্যমন্ত্রী। একের পর এক জবাব, প্রশ্ন-কোনকিছুই বাদ দিলেন না। প্রধানমন্ত্রীকে হরিদাস, মহম্মদ বিনতুঘলকের ঠাকুরদা (দাদা), হিটলারের জ্যাঠামশাই(চাচা), ফ্যাসিবাদি বলে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, ‘হঠাৎ মনে হল নোট বাতিল করে দিল, জিএসটি করে দিল, হটাৎ করে উনি চৌকিদার হয়ে গেলেন, কখনও রাজা হচ্ছেন, হটাৎ মনে হল চায়ওয়ালা হয়ে গেলেন, জামা-প্যান্ট পর্যন্ত নিজের নামে বিক্রি করছে এখন আবার নিজের নামে সিনেমাও করেছে-তবেই বুঝুন।’
রাজ্যে দুর্গাপুজো, লক্ষীপুজো, স্বরস্বতী পুজো হয় না বলে বিজেপির অভিযোগকে খন্ডন করে মমতা এদিন বলেন, ‘মা দুর্গার কয়টা হাত আছে তারা কি জানে? মা দুর্গা কাকে বধ করেছিল তারা জানে? আগামী দিনে মা দুর্গার মতো ঘরের নারীরা তোমার এই অশুভ শক্তিকে বধ করবে।’
সব শেষে মমতা বলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এটা বাংলার নির্বাচন নয়, এটা দিল্লি দখলের নির্বাচন। কিন্তু এরাজ্য থেকে ৪২ টা আসনের মধ্যে ৪২ টাতেই জিতে এই বাংলাই দিল্লির সরকার গড়বে। বাংলাই পথ দেখাবে। আমাদের একটাই লক্ষ্য ‘মোদি হাটাও দেশ বাঁচাও’ আর সেই লক্ষ্যেই আমরা সকলে একত্রিত হয়ে কাজ করছি। কারণ এরা (বিজেপি) যদি ফের ক্ষমতায় আসে তবে সংবিধান বদলে দেবে, নির্বাচনই থাকবে না।’
বিডি প্রতিদিন/হিমেল