পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ভাদু শেখকে বোমা মেরে খুনের পর বগটুই গ্রামে নৃশংসভাবে ৮ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বৃহস্পতিবার ওই গ্রামে যান রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন তিনি। আর মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়েই স্বজনহারাদের পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের কাছে সুবিচার দাবি করেন তারা।
এসময় স্বজনহারা ও ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ, সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতি এবং ওই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে রামপুরহাট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসারত মানুষদের সাথেও দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তার অভিযোগ, এই ঘটনার পিছনে বড় কোন ষড়যন্ত্র আছে। এমনকি বাইরের কেউ জড়িত আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিন বগটুই গ্রামে দাঁড়িয়ে ওই বর্বরোচিত ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করার পাশাপাশি ঘটনার স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ও বগটুই ব্লক প্রেসিডেন্ট আনারুল হোসেনকে অবিলম্বে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বজনহারাদের অভিযোগ, আনারুলের মদদেই ওই রাতে গণহত্যা চলেছিল।
আর সেই প্রসঙ্গ তুলেই এ দিন রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্যকে উদ্দেশ্য করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দারা আনারুলকে জানিয়েছিল। কিন্তু সময়মতো সেখানে পুলিশ পাঠায়নি। সেদিন সময়মতো পুলিশ পাঠালে ওই ঘটনা হয়তো নাও ঘটতে পারতো। তাকে দ্রুত গ্রেফতার করা হবে। দ্বিতীয় এখানকার রামপুরহাট মহকুমা পুলিশ (এসডিপিও) কর্মকর্তা যখন দেখলেন যে একজন (ভাদু শেখ) খুন হলেন, তারপর নতুন করে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কেন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি? কারণ এর আগেও এখানে একাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। তাই এসডিপিও ও রামপুরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। তাই যারা দায়িত্ব পালন করেননি এবং এই ঘটনায় মদদ দিয়েছে আমি তাদের কঠোর শাস্তি চাই। মামলা এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে তারা আদালতে কোনোভাবেই ছাড়া না পায়। অভিযুক্তরা যেখানেই পালিয়ে যাক না কেন, তাদের ধরে নিয়ে আসতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘অভিযুক্তদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এই ধরনের ঘটনা না ঘটাতে পারে। সকলেই এদের দেখে শিক্ষা নেবে।’
রাজ্য পুলিশের ডিজিকে গোটা রাজ্য জুড়ে তল্লাশি অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এও বলেন, ‘সারা বাংলা জুড়ে তল্লাশি চালাও যাতে যেখানে বোমা আছে, যেখানে যন্ত্রপাতি আছে- সব উদ্ধার করতে হবে। যে পুলিশ সক্রিয় হয়ে কাজ করবে তাকে সালাম জানাবে, আর যে কাজ করবে না, এনজয় করে বেড়াবে তার পুলিশে চাকরি করার প্রয়োজন নেই।’
ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে মমতা বলেন, ‘এটা ভীষণ ভয়াবহ ঘটনা। আমি ভাবতেই পারিনি যে কখনও এত নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা যখন আধুনিক যুগে যাচ্ছি তখন এখানে অশান্তির আগুন এবং সেটি কয়েকটা লোকের জন্য। ভাদু শেখ খুন হয়েছে তার পর আরও ১০টা বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে এবং সেখানেও ৮ জন মারা গেছে।
তার অভিযোগ ‘এই ঘটনার পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আছে। একজনকে খুন করা হলো তার পর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হলো। এই ঘটনায় বাইরের কেউ জড়িত ছিল কি না-সব দিক খতিয়ে দেখা হবে। আমি এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করবো না। পুলিশ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করবে এবং কঠোর পদক্ষেপ নেবে।’
স্বজনহারাদের পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কোটা থেকে স্বজনহারা ১০টি পরিবার পিছু একজনকে সরকারি চাকরি, ৫ লাখ রুপি আর্থিক সহায়তা এবং তাদের ঘরবাড়ি পুননির্মাণের জন্য ২ লাখ রুপি আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেন মুখ্যমন্ত্রী।’
নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের সাথে সাক্ষাতের পর আহতদের দেখতে রামপুরহাট হাসপাতালে যান মমতা। পরে মুখ্যমন্ত্রী জানান ‘চিকিৎসকরা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালে ৫ জনের চিকিৎসা চলছে। ৬০ শতাংশ অগ্নিদগ্ধ হওয়া এক নারীর চিকিৎসার জন্য ১ লাখ রুপি এবং অল্প আহতদের জন্য ৫০ হাজার রুপি আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে।’
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে রামপুরহাট ১ নম্বর ব্লকের বরশাল গ্রামের উপপ্রধান ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতা ভাদু শেখকে বোমা মেরে খুনের অভিযোগ ওঠে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যেই রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। রাতভর চলে বোমাবাজি। অন্তত ১০-১২ টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ঘটানো হয়। অভিযোগ ভাদুর মৃত্যুর বদলা নিতেই তার অনুসারীরা ওই গ্রামে রাতভর তাণ্ডব চালায়। অভিযোগ বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আর তাতেই ৮ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও পাঁচ জন।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা