আমদানিকৃত পিয়াজ রাজধানীর শ্যামবাজার ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে আসার পর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট পাইকারি দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা সাধারণ একটি সূত্র ব্যবহার করছে, আর তা হলো, যে জাতের পিয়াজ যেখান থেকেই আমদানি হোক না কেন পাইকারি পর্যায়ে তার চেয়ে কমবেশি দ্বিগুণ দামে বিক্রি করতে হবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছেন, আমদানির দ্বিগুণ দামে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। আর সে কারণে দেশে পিয়াজের সরবরাহ বাড়লেও এবং পাশাপাশি দেশি পিয়াজ বাজারে ওঠার পরও পিয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারি সংস্থাগুলোর বাজার মনিটরিং, শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃক আমদানিকারকদের জিজ্ঞাসাবাদ, পণ্য আমদানিতে সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার পরও নিয়ন্ত্রণহীন রয়েছেন পিয়াজ ব্যবসায়ীরা। তারা সিন্ডিকেট করে পণ্যটির দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। ফলে আমদানি মূল্য অর্ধেক হওয়ার পরও পিয়াজ বিক্রির ক্ষেত্রে দ্বিগুণের বেশি দাম রাখার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মিসর ও তুরস্কের পিয়াজ ৪০ থেকে ৪২, চাইনিজ পিয়াজ ২৫ থেকে ৩০ ও মিয়নমারের পিয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে আমদানি করা হচ্ছে। অথচ খুচরা বাজারে প্রতিটি প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানান, পিয়াজের দাম নির্ধারণে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের একটি আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। তারা নিজেরা আলোচনা করে এ অঞ্চলের পিয়াজের আমদানি ও পাইকারি মূল্য নির্ধারণ করছে। এ কারণে বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও এখন কেজিপ্রতি পিয়াজ ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী ওয়ারেছি এই আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের বিষয়টি স্বীকার করে সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালনের সময় পিয়াজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করেছি। তারা আমাকে বলেছেন, ভারত থেকে পিয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে সে দেশের ব্যবসায়ীরাই মৌখিকভাবে দাম নির্ধারণ করে দেন। এ ক্ষেত্রে এলসিতে একটি অঙ্ক বসানো হয় শুধু। এরপর চুক্তিবদ্ধ দামে বিক্রীত পিয়াজের লাভের অংশ সীমান্তের ওপারের ব্যবসায়ীদের কাছে হুন্ডিতে পৌঁছে যায়।’ সাবেক এই অতিরিক্ত সচিব জানান, এখন ভারত থেকে পিয়াজ আনা বন্ধ হলেও মিয়ানমারের সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। ফলে বর্ডার ট্রেডে আনা এসব পিয়াজের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিষয়টি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর এ কারণেই সরকারের নানা উদ্যোগের পরও পিয়াজের দাম কমছে না। শ্যামবাজারের পিয়াজ আমদানিকারক রফিকুল ইসলাম জানান, গতকাল তারা চীনের পিয়াজ ৫০, মিসরের ৮০ থেকে ৯০ ও মিয়ানমারের পিয়াজ ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করছেন। তিনি স্বীকার করেন, খুচরা পর্যায়ে কোনো কোনো জাতের পিয়াজ আমদানির প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে সেগুলো আগে বেশি দামে কেনা হয়ে থাকতে পারে বলে এই ব্যবসায়ীর অভিমত। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘আমরা মিসর ও তুরস্কের পিয়াজের আমদানি খরচ সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি। তবে মিয়ানমার থেকে যে পিয়াজটি ব্যবসায়ীরা আনছেন তার আমদানি খরচ কত পড়ছে তা জানা যায়নি। পাশের দেশের এই পিয়াজ দেখতে অনেকটা দেশি পিয়াজের মতো বলে খুচরা পর্যায়ে দাম বেশি পড়ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। তবে পণ্যটির প্রকৃত আমদানিমূল্য জানার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে।’ সচিব জানান, মিয়ানমার থেকে এলসিবিহীন বর্ডার ট্রেডে পিয়াজ আনার কারণে এর সঠিক দাম সংগ্রহ করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমদানিকারকদের জিজ্ঞাসা করে যে তথ্য নিচ্ছে তা যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো গরমিল পেলেই অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দূতাবাসে চিঠি : এদিকে পিয়াজের বাজার স্থিতিশীল করতে ভারত ও মিয়ানমারে পণ্যটির উৎপাদন, মজুদ, রপ্তানির পরিমাণ ও সরবরাহকাল সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়ে দেশ দুটির বাংলাদেশ মিশনে চিঠি পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য সচিব জানান, বাজারদর নিয়ন্ত্রণে ওই দেশ দুটির পিয়াজের উৎপাদন, মজুদ, রপ্তানিযোগ্য পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলে পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করা সহজতর হয়। এ কারণে ভারত ও মিয়ানমারে এ মৌসুমে পিয়াজের উৎপাদন, মজুদ ও রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ, বাজারদর এবং সরবরাহকাল-সংক্রান্ত তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির আমদানিকৃত প্রায় ৫ হাজার টন পিয়াজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে এমন তথ্য দিয়ে সচিব বলেন, এসব পিয়াজ দ্রুত খালাস করতেও বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।