সোমবার, ১৩ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বিপৎসীমার ওপরে ১০ নদীর পানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিপৎসীমার ওপরে ১০ নদীর পানি

পানিতে ডুবে গেছে ঘরবাড়ি। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে লালমনিরহাটের মহিষখচা ইউপির কুটিরপাড় এলাকার বাসিন্দারা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ১০টি নদ-নদীর পানি ১৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টা নাগাদ দেশের ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের ৭৭টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত অবনতি হতে থাকে বন্যা পরিস্থিতি। আজকের মধ্যে আরও ৭ থেকে ৮টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার পূর্বাভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে প্লাবিত হতে পারে নতুন নতুন এলাকা।

বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির তিন-চার দিন পার না হতেই দ্বিতীয় দফা বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট, নওগাঁ, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল। স্রোতে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু। ডুবে গেছে বীজতলা। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অনেক এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। অসংখ্য মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে উঁচু সড়ক, বেড়িবাঁধে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। তীব্র খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে আছে বানভাসীরা। এরই মধ্যে অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে নদ-নদীর পানি। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী সুরমা, ধরলা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র  তিস্তা, গুড়, যদুকাটা, করোতোয়া, আত্রাই, ধলেশ্বরী, তুরাগ, পুনর্ভবা, পদ্মা, ইছামতি, মাথাভাঙ্গা, পশুর, কুশিয়ারা, খোয়াই, সোমেশ্বরী, মেঘনা, মুহুরী, সাঙ্গুসহ দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুত গতিতে। গতকাল সকাল নাগাদ ১০১টির মধ্যে সমতল স্টেশনের ৭৭টিতে পানি বৃদ্ধি পায়। এর আগের দিন বৃদ্ধি পেয়েছিল ৬৬টি স্টেশনে। গতকাল সকালে ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, গুড়, সুরমা, সারিগোয়াইন, পুরাতন সুরমা, যদুকাটা ও সোমেশ্বরী নদীর পানি ১৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আজকের মধ্যে আরও কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা রয়েছে। পাউবোর গতকালের পূর্বাভাস অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি সমতল অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী তিন দিন তা অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে এবং পদ্মা নদী গোয়ালন্দ পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। তিস্তা ও ধরলার পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে বিপৎসীমার ওপরে অবস্থান করতে পারে। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলে ভারী বৃষ্টির কারণে সাঙ্গু, হালদা, মুহুরী ও মাতামুহুরী নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, গাইবান্ধা, জামালপুর, নাটোর, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলায়। আমাদের বিভিন্ন জেলার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন বন্যার সর্বশেষ পরিস্থিতি। সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর পয়েন্টে ফের বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩১টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। প্রায় ২৫ হাজার পরিবারের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চরাঞ্চলের পানিবন্দী মানুষ দিনরাত পানিতে থাকায় পানিবাহিত নানা রোগ দেখা দিয়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলেও দুর্ভোগ বেড়েছে। চুলা ডুবে যাওয়ায় ও লাকড়ি ভিজে যাওয়ায় রান্না করতে পারছে না অনেক পরিবার। বিশুদ্ধ পানির সংকটে ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেওয়া অনেকে যমুনার পানি পান করছে। এতে পেটের পীড়াসহ নানা রোগ দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে যমুনার অরক্ষিত অঞ্চলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী আগামী ৭২ ঘণ্টা যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। কুড়িগ্রাম : ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রসহ সবকটি নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে।

 কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে ধরলা নদীর সেতু পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার, তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ২২ সেন্টিমিটার এবং দুধকুমার নদীর নুনখাওয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দ্বিতীয় দফা বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নতুন করে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। প্রথম দফায় তলিয়ে যাওয়া বিভিন্ন ফসল আবারও নিমজ্জিত হয়েছে। দিশাহারা হয়ে পড়েছে কৃষক। সদরের কালুয়ার চর ও হলোখানার সারডোব এলাকায় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ ১৯টি পয়েন্টের বাঁধ নদীভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম জানান, বন্যা মোকাবিলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। সুনামগঞ্জ : দ্বিতীয় দফা বন্যার তৃতীয় দিনেও নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল জেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও নদীর ভাটিতে অবস্থিত এলাকায় বেড়েছে পানির উচ্চতা। দুপুর ১২টার সুরমা নদীর পানি সুনামঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। দিনভর থেমে থেমে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় অনেকেই উঠেছেন সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর, ষোলঘর, কাজির পয়েন্ট, নতুনপাড়া, হাজিপাড়া, তেঘরিয়া, বড়পাড়াসহ বেশিরভাগ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। পানির কারণে গোটা শহর কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। শহরের নিচু এলাকার বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে ঢুকে পড়েছে পানি। গাইবান্ধা : গতকাল ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ২  সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধিতে গাইবান্ধার সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের বসতবাড়ি আবারও পানিতে নিমজ্জিত হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। নীলফামারী : নীলফামারীর ডিমলায় তিস্তার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দিন দিন বেড়েই চলছে পানিবন্দীর সংখ্যা। গতকাল তিস্তা অববাহিকায় নতুন করে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩০ হাজার মানুষ। এই জেলায় তিস্তার পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাজশাহী : উজানের ঢলে রাজশাহীতে প্রতিদিনই পদ্মার পানি বাড়ছে। রাজশাহীর অনেক স্থানে পদ্মার পাড় ভাঙতে শুরু করেছে। ঝুঁকিতে আছে শহর রক্ষা বাঁধ। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আলীপুর ও নাপিতপাড়া এলাকায় পদ্মার পাড় ভাঙতে শুরু করেছে। স্থানীয়দের মতে, অর্ধশতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কোহিনুর আলম জানান, শ্রীরামপুর শহর রক্ষা বাঁধের নতুন ডিজাইন জমা দেওয়া হয়েছে। এখনো পাস হয়নি। তবে বাঘার নদীর পাড় বাঁধার প্রকল্প পাস হয়েছে। কাজ শুরু করা হয়নি। রংপুর : তিস্তার আকস্মিক পানি বৃদ্ধিতে রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার নদী তীরবর্তী ৫০ গ্রাম তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ২০ হাজার পরিবার। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকে তিস্তার বাঁধে গবাদিপশুসহ আশ্রয় নিয়েছে। অনেকের ঘরে হাঁটু কিংবা কোমর পানি ওঠায় চুলা জ্বালাতে পারছে না। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে কালনী-কুশিয়ারা, বশিরাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করায় বন্যা দেখা দিয়েছে। গতকাল বিকালে কালনী-কুশিয়ারা নদীর পানি আজমিরীগঞ্জ উপজেলা সদর ইউনিয়ন, কাকাইলছেও  ও পাহাড়পুর অংশে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আজমিরীগঞ্জ-কাকাইলছেও সড়ক ডুবে বিভিন্ন গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। এতে প্লাবিত হয়েছে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ১৫টি  গ্রামের নিম্নাঞ্চল। বগুড়া : যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যমুনা নদীর পানি গতকাল বেলা ৩টায় বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আবার পানি বৃদ্ধিতে নদী তীরবর্তী অসংখ্য মানুষ বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সারিয়াকান্দি উপজেলার ১০টি চরের প্রায় ১৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নাটোর : অতি বৃষ্টিপাতের কারণে নাটোরের সিংড়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে নদী ও বিলের পানি। বর্তমানে আত্রাই নদীতে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এতে উপজেলার আনন্দনগর, বিলদহর, নুরপুর, ভুলবাড়িয়া, একলাসপুর গ্রামের বেশ কিছু বাড়িঘর, রাস্তা, দোকান ডুবে গেছে। এদিকে সিংড়া-কলম সড়কের বলিয়াবাড়ী রাস্তা যে কোনো সময় ধসে যাওয়ার আশঙ্কা করছে উপজেলা প্রশাসন। লালমনিরহাট : তিস্তা ব্যারাজ ও আশপাশের চরাঞ্চলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হচ্ছে বলে গতকাল দুপুরে জানিয়েছেন ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান। সেই সঙ্গে চরঞ্চলে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। পাউবো সূত্র জানায়, গতকাল বিকালে লালমনিরহাটে তিস্তার পানি ব্যারাজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার, ধরলা কুলাঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ক্রমেই পানি বাড়ছে। তিস্তা-ধরলার পানিতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার অন্তত ৬০ হাজার মানুষ। বানভাসী এলাকায় দেখা দিয়ে চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট।

 

সর্বশেষ খবর