সোমবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

একটি এসএমএস খুলে দিল খুনের রহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

একটি এসএমএস খুলে দিল খুনের রহস্য

বাবা আর ভাইকে নিয়ে একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে নেয় রবিউল। ঘুমাতে যায় নিজ ঘরে। পরদিন সকালে নাস্তা খেতে সবাই বসলেও রবিউল নেই। তাকে ডাকাডাকি করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অগত্যা রবিউলের বাবা নিজেই ঘরে গিয়ে খোঁজ করেন। ঘরে নেই! তবে কোথায় রবিউল? এমন প্রশ্ন রবিউলের বাবার মনে। পরক্ষণেই তিনি ভাবছেন, বাইরে বেড়াতে গেল না তো ছেলেটা! সারাটা দিন কাটে এভাবেই নানান চিন্তায়। দিন শেষে রাত আসে। ফিরে না রবিউল। হঠাৎ রবিউলের ভাইয়ের ফোনে একটা এসএমএস আসে। ‘তোর ভাইকে বাঁচাতে চাইলে ৫০ লাখ টাকা পাঠা’। এবার সবাই নড়েচড়ে বসে। রবিউলের ভাই আর বাবা এমন সংবাদ শুনে হতবিহŸল। তারা কী করবেন, কোথায় যাবেন বুঝতে পারছেন না। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। হঠাৎ তাদের মনে পড়ে রবিউলের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মামুনের কথা। ওর ওখানে যায়নি তো? মাথায় এমন প্রশ্ন জেগে উঠতেই তারা ছুটে যান মামুনের বাসায়। রবিউলের কথা শুনেই তিনি আকাশ থেকে যেন পড়লেন। তিনিও বাসা থেকে বেরিয়ে যান। খুঁজতে থাকেন প্রিয় বন্ধু রবিউলকে। কিন্তু দিন যায়, সপ্তাহ যায় খোঁজ মেলে না রবিউলের। ঘটনাটি পাবনা জেলার। ঘটেছে সুজানগর উপজেলার উলট নামের গ্রামে। রবিউলের খোঁজ না পাওয়ায় সুজানগর থানায় ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর একটি সাধারণ ডায়েরি করেন রবিউলের ভাই। জিডি নম্বর-৯৩৬। তদন্তের দায়িত্ব পড়ে এসআই বেলালের ওপর। বিভিন্ন সূত্র ধরে তিনি এগোতে থাকেন। একপর্যায়ে রবিউলের জন্য পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন তার বাবা। ৫ অক্টোবর হৃদয় নামের একজনকে আসামি করে অপহরণ মামলা করেন তিনি। মামলা নম্বর-১১। পুলিশ হৃদয়কে  গ্রেফতার করে। তার স্বীকারোক্তিতে গ্রেফতার হন আরও পাঁচজন। তারা টাকা চাওয়ার কথা স্বীকার করলেও রবিউলের কোনো হদিসই দিতে পারে না। পরে জানা যায়, মারের ভয়ে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছিল। সব যেন গোলমেলে লাগছিল গোয়েন্দাদের কাছে। তদন্তের ভার পান ডিবির এসআই অসিত। অদম্য কৌত‚হলী অসিত সব শুনে মনোযোগ দিলেন রবিউলের জীবন-যাপনের ওপর। ঘটনা ঘাঁটাঘাঁটির একপর্যায়ে জানতে পারলেন, রবিউলের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছিল মামুনের। মামুন কোথায়? পুলিশ খোঁজে তাকে। ঘটনার ১০-১৫ দিন পরই ঢাকায় চলে গেছেন চাকরির খোঁজে। নানা প্রলোভনে ডেকে আনা হলো মামুনকে। কী নিষ্পাপ চেহারা! শ্মশ্রুমন্ডিত মুখ। ২০-২২ বছরের  টকবগে এক যুবক মামুন। কী হাসিখুশি। কোরআন হাদিসের জ্ঞান অগাধ। শুধু একটা বিষয় তার অজানা। আর তা হলো পুলিশি জেরা। রবিউল যেদিন নিখোঁজ হয়, সেদিন তার মোবাইলের শেষ কলে মামুনকে কী বলেছিল? আর তাকে পাঠানো এসএমএসটা কী ছিল? এই দুই প্রশ্নের জালেই ফেঁসে যান  মামুন। তাকে বলতেই হয় সেই ভয়ঙ্কর রাতের কথা। একটি মেয়েকে ভালোবাসত রবিউল। কিন্তু মামুনও তাকে ছাড়া বাঁচবে না। কিন্তু একজন মেয়ের জন্য তো একজন পুরুষ। দ্বিতীয়টি কেন থাকবে। বুঝিয়ে ওই পথ থেকে সরাতে পারেনি রবিউলকে। যে কারণে তাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটেন। সেই রাতে রবিউলকে মামুন তার বাসায় ডেকে আনেন। এরপর পূর্বপরিকল্পিতভাবে কৌশলে রবিউলকে কড়া ঘুমের ওষুধ মেশানো পানি খাওয়ান তিনি। পরিকল্পনা মতো শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন রবিউলকে। তারপর ঘরের মধ্যে একাই লাশের জানাজা পড়ান তিনি। এখন লাশ রাখবেন কোথায়? ধরা তো পড়ে যাবেন। তাই নিজ ঘরেই দাফনের ব্যবস্থা করে নেন। প্রিয় বন্ধুকে শোবার চৌকির পাশে মেঝের মাটিতে পুঁতে রাখেন। এরপর তাহাজ্জুত নামাজ আদায় করেন মামুন। পরের দিন খুব স্বাভাবিকভাবে রবিউলের বাপ-ভাইদের সঙ্গে দেখা করেন। রবিউলকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। আবার ফাঁকে ফাঁকে পরিচয় গোপন করে মোবাইল ফোনে রবিউলের ভাইয়ের কাছে মুক্তিপণের টাকাও দাবি করেন হত্যাকারী মামুন। কিছু দিন পর মামুন চলে যান ঢাকায়। কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় না, কী হয়ে গেছে। কে জানত কোনো এক এসআই অসিত বা বেলালের মতো পুলিশ তার মেধা কাজে লাগিয়ে বের করে আনবেন ঘটনার ভিতরের ঘটনা।

সর্বশেষ খবর