করোনা মহামারীর কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে কর্মহীন হয়েছে অসংখ্য কর্মক্ষম মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে নতুন চাকরির সুযোগও কমেছে। এ কারণে প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থানে কী ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে, সেদিকে লক্ষ্য রয়েছে সবার। সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে এ বিষয়ে বেশ কিছু কৌশলের কথা তুলে ধরেছে অর্থ বিভাগ। কর্মসংস্থানের বিষয়ে সেখানে বলা হয়েছে, দেশের বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য দুটি পৃথক প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ১২ লাখ ৬৮ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ ছাড়া বেকার তরুণ, বিদেশফেরত কর্মহীন এবং নিম্ন আয়ের মানুষকে আত্মকর্মসংস্থান তৈরিতে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও এনজিওগুলোর মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হবে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। প্রবাসে কর্মসংস্থান বাড়াতে নতুন গন্তব্য খোঁজা হবে। বাড়ানো হবে প্রবাসীদের সুযোগ সুবিধা।
দেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে। এর মধ্যে ৬ থেকে ৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয় বিদেশে। তবে করোনা মহামারীর কারণে দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে স্বাভাবিক বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্বের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনাভাইরাসের কারণে সেটি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে বলে বিভিন্ন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারীতে বিশ্বে ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে, আর বাংলাদেশে বেকার হয়েছে চারজন যুবকের মধ্যে একজন, যা প্রায় ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তার গবেষণায় দেখানো হয়- দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের কৌশল কী- সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ঘোষিত বাজেটে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার প্রচেষ্টা রয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউনের প্রভাবে বিপর্যস্ত শিল্প খাত বাঁচাতে রয়েছে একগুচ্ছ প্রণোদনা আর কর সুবিধার প্রস্তাব। শিল্প খাতে এই প্রণোদনা যদি উদ্যোক্তাদের নতুন বিনিয়োগে নিয়ে আসেন তবে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে কর্মসংস্থান প্রশ্নে এ ধরনের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে, ফলে সব সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে তারাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।তবে করোনাভাইরাস সংকটে যখন সারা বিশ্বে চাকরির বাজার সংকুচিত হচ্ছে, সেখানে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরিয়েই কর্মহীন মানুষদের জন্য কাক্সিক্ষত কর্মসংস্থান সৃষ্টি সম্ভব কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন কর্মহীন ও বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর এটি করার জন্য একটি রূপরেখা সরকারের আর্থিক নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের মধ্যমেয়াদি আর্থিক নীতি বিবৃতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি বিষয়ে বলা হয়েছে, স্বল্প সুদে ঋণ সহায়তা সম্প্রসারণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য রয়েছে। গ্রামের দরিদ্র কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত ও বেকার যুবকদের কৃষিক্ষেত্রে, কৃষি সংশ্লিষ্ট উৎপাদন ও সেবা, গ্রামীণ অঞ্চলে ক্ষুদ্র ব্যবসায় এবং আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত রাখতে উদ্বুদ্ধ করবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি সংশ্লিষ্ট ঋণ কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য ৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেওয়া হবে। কর্মসংস্থান ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, আনসার ভিডিপি ব্যাংক এবং পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এই ৫টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসব ঋণ বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া গ্রামীণ অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে এবং পল্লী অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে আরও ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার একটি কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশন ও এনজিও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এসব ঋণ কর্মহীনদের মধ্যে কর্ম সৃষ্টির জন্য বিতরণ করা হবে।
নীতি বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকার দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে, যার মাধ্যমে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর দক্ষতা, শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও মজুরি বৃদ্ধি করা অন্যতম লক্ষ্য। এর মধ্যে অর্থ বিভাগের ‘স্কিলস ফর অ্যামপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টম্যান্ট প্রোগ্রাম’ প্রকল্পের মাধ্যমে ৮ লাখ ৪১ হাজার ৬৮০ জন যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যেটি দেশে ও বিদেশে কর্মহীন মানুষদের কাজ পেতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের দেশে এবং বিদেশে কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ২৭ হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদি সংস্কার/কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজস্ব বাজেটের আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ১৩ লাখ ৪৮ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন নতুন দেশে বাংলাদেশিদের চাকরির সুযোগ খোঁজা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সরকারের মধ্যমেয়াদি নীতি বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, বর্তমানে বিশ্বের ১৭৪টি দেশে ১ দশমিক ২ কোটিরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছেন। প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশির বিদেশে কর্মসংস্থান হয়। এটি আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন, প্রবাসীদের কল্যাণে গৃহীত নানা পদক্ষেপ, যেমন- স্মার্টকার্ড প্রবর্তন, মোবাইল অ্যাপে ভিসা চেকিং ও মাইগ্রেশন আইনের সংস্কার করা হচ্ছে।