রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ইমামের খুনি ছিলেন ইমাম

মির্জা মেহেদী তমাল

ইমামের খুনি ছিলেন ইমাম

নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া মল্লিকেরপাড়ার বাইতুল জালাল জামে মসজিদ। ফজরের নামাজ আদায় করতে মুসল্লিরা আসছেন। দোয়া দরুদ পড়ছেন তারা। ফজরের নামাজ আদায়ের সময় হয়ে আসছে। কিন্তু মসজিদের ইমাম দিদারুল ইসলামের কোনো খবর নেই। মুসল্লিরা অপেক্ষা করছেন তার জন্য। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছেন ইমাম সাহেব না আসায়। মুসল্লিদের কেউ কেউ মসজিদ থেকে বেরিয়ে ইমামের খোঁজ করছেন। কিন্তু ইমামের কোনো সাড়াশব্দ নেই। মসজিদের অজুখানা, টয়লেট কোথাও নেই। তারা ইমামের কক্ষে যান। দরজায় কড়া নাড়েন। ভিতর থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দেন তারা। দরজাটি খুলে যায়। ভিতরে তাকাতেই মুসল্লিরা আঁতকে ওঠেন। ইমামের দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভাসছে চৌকি। মুসল্লিরা ভয় পান। তাদের চিৎকারে আরও মুসল্লি এগিয়ে আসেন। তারা ভিতরে ঢুকেই দেখতে পান, ইমামের মাথা বিচ্ছিন্ন। দেহের পাশেই মাথা পড়ে আছে। যে ইমামের পেছনে নামাজ আদায়ের জন্য মুসল্লিরা অপেক্ষা করছিলেন, নামাজের কিছু আগেই সেই ইমামের গলা কাটা লাশ উদ্ধারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মুসল্লিদের ভিতর।

সংবাদ পেয়ে পুলিশ আসে ঘটনাস্থলে। লাশ উদ্ধার করে। রুমে তল্লাশি চালায় পুলিশ। পুলিশ মৃতদেহের পাশ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘হিজবুত তাওহীদের সদস্য, সে আমাদের দল থেকে অস্ত্র ও টাকা  নিয়ে পালিয়ে এসেছে, তাই তাকে আমরা মেরে ফেলেছি’।  এ ছাড়া আরও কিছু কথা এ সংক্রান্তে লেখা ছিল। ঘটনাটি ২০১৯ সালের ২১ আগস্টের। এ ঘটনার ব্যাপারে দিদারুলের ভাই বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশকে ভাবিয়ে তুলে ডায়েরির লেখাগুলো। দিদারুল ইসলাম কি আদৌ কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না, এ ব্যাপারে খোঁজ নেয় পুলিশ। কিন্তু তার বিষয়ে এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ভিন্ন মতাদর্শের কারও কাজ কি না এটিও পুলিশ তদন্তের আওতায় নেয়। কিন্তু ওই ধরনের কোনো তথ্য পায় না পুলিশ। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে সন্দেহের প্রতিটি জায়গায় স্পর্শ করে যাচ্ছে। পুলিশ তদন্তের এক পর্যায়ে জানতে পারে, দিদারুলের কাছে তার এক বন্ধু প্রায়ই আসতেন মসজিদে। এটি অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু ঘটনার পর তাকে কেউ দেখেনি আসতে। পুলিশ দিদারুলের মোবাইল ফোনের কললিস্ট বের করে। এরপর সন্দেহভাজন নম্বরগুলোতে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। এর মধ্যে একটি নম্বরে বেশি কথা বলেছেন দিদারুল। ওই নম্বরটির মালিক ওহিদুজ্জামান। পুলিশ তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে শুরু করে। তাকে ফোন করা হলেও নিজের অন্য নাম বলে ফোনের লাইন কেটে দিত। এতে পুলিশের সন্দেহের তীর তখন ওহিদুজ্জামান। পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ওহিদুজ্জামানকে অনুসরণ করে ২৮ আগস্ট তাকে পাকড়াও করে। মাদারীপুর জেলার শিবচর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

ওহিদুজ্জামানকে গ্রেফতার করে সোনারগাঁ নিয়ে আসার পর জেরা করা হয়। কিন্তু বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। জেরা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ইমাম দিদারুল খুনের সবকিছু বলে দেয়। ওহিদুজ্জামান নিজেও একজন ইমাম। মাদারীপুরের শিবচরের একটি মসজিদের ইমাম এবং দিদারুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মসজিদের ইমাম দিদারুল ইসলামের কাছ থেকে ব্যবসার কথা বলে কয়েক দফা লক্ষাধিক টাকা নেন ওহিদুজ্জামান। কিন্তু পরে দিদারুল জানতে পারেন, ব্যবসাটি বৈধ নয়। সোনার বার কেনাবেচার ব্যবসা করতেই টাকা নেন ওহিদুজ্জামান। এ কারণে টাকাগুলো ফেরত চান দিদারুল। দেই, দিচ্ছি বলে ঘোরাতে থাকেন ওহিদ। এক পর্যায়ে টাকা ফেরত চেয়ে ঘন ঘন চাপ দিলে ওহিদ তার বন্ধু মসজিদের ইমাম দিদারুল ইসলামকে খুনের পরিকল্পনা আঁটেন। সেই পরিকল্পনা মতো ঘটনার আগের রাতে ২০ আগস্ট দিদারুলের সঙ্গে মসজিদে দেখা করে বলেন, ২১ আগস্ট রাতে এশার নামাজের পর পাওনা টাকা ফেরত দেবেন। এর আগে ওহিদ শিবচরের পাঁচচর এলাকা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি ক্রয় করেন। সোনারগাঁ মোগরাপাড়া থেকে ঘুমের ওষুধ ও কোকাকোলার বোতল কিনেন। এশার নামাজের পর তিনি দিদারুলের ঘরে যান। কোকের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ইমাম দিদারুল ইসলামকে খাইয়ে দেন। জ্ঞান হারান দিদারুল। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী চাপাতি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করেন। হত্যার পরে দিদারুলের ব্যবহৃত ডায়েরিতে ‘হিজবুত তাওহীদের সদস্য, সে আমাদের দল থেকে অস্ত্র ও টাকা নিয়ে পালিয়ে এসেছে তাই তাকে আমরা মেরে ফেলেছি’ এমন আরও কিছু লিখে দেন ঘাতক বন্ধু ওহিদ। খুন করার পর অজুখানায় গিয়ে গোসল করেন ওহিদ। পাশের একটি পুকুরে কচুরিপানার মধ্যে চাপাতি ফেলে দেন। পুলিশ জানায়, হত্যাকান্ডটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাওহীদের নাম ব্যবহার করেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর