শনিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়ংকর বাচ্চু ডাকাত এলাকায় ছিল দানবীর

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ংকর বাচ্চু ডাকাত এলাকায় ছিল দানবীর

ভয়ংকর ডাকাত দলের নেতা বাচ্চু। রাজধানীসহ সারা দেশেই তার দলের সদস্য রয়েছে। আজ ঢাকায়, তো কাল চট্টগ্রামে। কাল চট্টগ্রামে তো পরশু সিলেটে। এভাবেই প্রতিদিন ডাকাতি করে চলছে বাচ্চু। মানুষের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে বাচ্চু বাহিনী। পুলিশ প্রশাসনও বিপাকে। বাচ্চু ডাকাতকে

কোনোভাবেই পাকড়াও করা যাচ্ছে না। শতভাগ তথ্য নিয়ে অভিযান চালালেও যেভাবেই হোক সে কেটে পড়ত। যে কারণে বাচ্চু ডাকাতকে জাদুকর বলতেন পুলিশের অনেকেই। ঢাকার মিরপুরে তার বাড়ি হলেও পুলিশ ছিল অসহায়। আশির দশকে এই বাচ্চু ডাকাতের ভয় দেখিয়ে বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানো হতো বলেও অনেক গল্প রয়েছে। আশির দশকের শেষ সময়ে বাচ্চুকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তবে তাকে গ্রেফতারের জন্য ছদ্মবেশ নিয়ে তার বাড়ির সামনে দিনের পর দিন ডিউটি করতে হয়েছে গোয়েন্দাদের। তৎকালীন সময়ে এই অভিযানে যুক্ত ছিলেন পুলিশের এমন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর নানা কাহিনি। আশির দশকের ঘটনা। মিরপুর তখন ঢাকার পার্শ্ববর্তী পৌরসভা। এ  পৌরসভার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ছিলেন হারুন অর রশিদ মোল্লা। যিনি হারুন  মোল্লা নামেই পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে মিরপুর ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়, হারুন মোল্লা সংসদ সদস্য হন। মিরপুর, পুরান ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জে ডাকাতির উপদ্রব বেড়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়ে রাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। গোয়েন্দা পুলিশের দল বাচ্চুু ডাকাতকে গ্রেফতারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গোয়েন্দারা জানতে পারে, ডাকাতির মূল হোতা বাচ্চু ডাকাতের বাড়ি মিরপুরে। চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন পার হয়ে একটি গ্রামে বাচ্চু ডাকাত থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার দিক থেকে খুবই নাজুক ওই এলাকা। বেশির ভাগই মাটির কাঁচা রাস্তা। গাড়ি চলাচলের চিন্তাই করা যায় না। গোয়েন্দারা বাচ্চু ডাকাতের সব খোঁজ-খবর নিলেন। ওই গ্রামে লোক নিয়োগ করলেন। সঙ্গে পুলিশের সোর্স। বাচ্চু ডাকাতের গতিবিধির ওপর নজরদারির জন্য। সব ঠিকঠাক থাকলেও তাকে আটক করে নিয়ে আসতে গ্রামের লোক বাধা হয়ে উঠতে পারে- এমন তথ্য ছিল পুলিশের কাছে। কারণ বাচ্চুর ডাকাতি কর্মকান্ড সম্পর্কে গ্রামবাসী ভালোভাবে জানত না। তারা সবাই বাচ্চু ডাকাতকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জানে। দান করতেন তিনি। তাই তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান হারুন মোল্লার সঙ্গে দেখা করে বাচ্চু ডাকাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে তার সহযোগিতা চান। হারুন মোল্লা সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। নজরদারি চলতে থাকল বাচ্চু ডাকাতের ওপর। এরই মধ্যে গোয়েন্দাদের কাছে খবর এলো বাচ্চু ডাকাতের পিতা তাদের বাড়ি বিক্রি করতে ক্রেতা খোঁজছেন। গোয়েন্দাদের ধারণা, বাড়ি বিক্রি করে ফেললে তাদের শিকার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা। তাই কী করা যায় ভাবতে শুরু করলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আকরাম হোসাইন। এত দূর এগিয়ে আর পিছপা হতে রাজি নন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ির ক্রেতা সেজেই বাচ্চু ডাকাতের বাড়িতে যাবেন। মিরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান হারুন মোল্লাকে অবহিত করলেন। এক দিন দুপুরের পরই দালালকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির ক্রেতা সেজে মিরপুরের বাচ্চু ডাকাতের বাড়ি দেখতে গেলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আকরাম। সিভিল পোশাকে এক দল পুলিশ আশপাশে রাখা হয়েছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। সবার পরনে লুঙ্গি শার্ট বা গেঞ্জি। বাড়ির ক্রেতা আকরাম হোসাইন প্যান্ট আর শার্ট পরিহিত ছিলেন। বিকালেই পৌঁছে গেলেন বাচ্চু ডাকাতের বাড়িতে। ঘুরে ঘুরে বাড়িটি দেখলেন এবং পছন্দ হয়েছে জানিয়ে বায়না বাবদ ১০ হাজার টাকা বাচ্চু ডাকাতের পিতার হাতে দিলেন। এরপর আকরাম হোসাইন তার কয় ছেলে মেয়ে, বিষয়াদি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে চাইলেন। তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে থাকলেও বড় ছেলে বাচ্চু বাইরে থাকায় তার দেখা পাচ্ছিলেন না আকরাম হোসাইন। তাই তিনি কৌশল খুঁজছিলেন কীভাবে বাচ্চুকে তার সামনে আনা যায়। এ সময় তিনি বাচ্চুর পিতাকে বলছিলেন, আপনার বড় ছেলে যদি বাড়ি বিক্রিতে আপত্তি করে তাই তার মতামত আমার জানা দরকার। তার মতামত না জেনে আমার বাড়ি কেনা ঠিক হবে না। এভাবেই সময় পার করে শিকারের অপেক্ষা করছিলেন। বাচ্চুর পিতা বারবার বলছিলেন, বড় ছেলে কোনো আপত্তি করবে না। এভাবে কয়েক ঘণ্টার বেশি সময় চলে যাওয়ার পরও বড় ছেলে বাচ্চুর দেখা পাচ্ছিলেন না। তাই সন্ধ্যার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় এলেন। এ সময় একটি চায়ের দোকানে সবাই চা পান উপলক্ষে একত্রিত হচ্ছিলেন। এমন সময় সোর্স জানাল বাচ্চু ডাকাত এদিকেই হেঁটে হেঁটে আসছে। কাক্সিক্ষত শিকার হাতের নাগালে চলে আসছে বুঝতে পেরে তিনি সতর্ক হলেন। এ সময় আকরাম হোসাইনের শরীর শিহরিত হয়ে উঠল। সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। তাদের কাছে আসতেই চারপাশ থেকে অপ্রস্তুত বাচ্চু ডাকাতকে ঘিরে ফেলে আকরাম হোসাইনের দলটি। পুলিশ পরিচয় দিয়েই দ্রুত বাচ্চুর হাতে হাতকড়া পরিয়ে গ্রাম থেকে রওনা দেন। তখন পৌরসভার চেয়ারম্যানের লোকেরা গ্রামবাসীদের কোনো ঝামেলা না করতে অনুরোধ করেন। এভাবেই কুখ্যাত বাচ্চু ডাকাতকে আটক করা হয়।

সর্বশেষ খবর