বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

মুদি আর চা দোকানি মিলে মানব পাচার চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

এইচএসসি পাস সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানার কামন্দ্রী গ্রামে মুদি দোকানদারি করতেন। একপর্যায়ে বিদেশে লোক পাঠানো দালালদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তার। ওই দালালদের মাধ্যমে গ্রামের কয়েকজনকে বিদেশে পাঠান। এরপর অধিক লোভের আশায় মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তারপর নিজেই হয়ে ওঠেন পাচারের হোতা। রাজধানীর বাড্ডায় খুলে বসেন তিনটি অবৈধ ওভারসিজ এজেন্সি। পরে দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যপ্রাচ্যে যেতে ইচ্ছুক নারী-পুরুষদের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, সাত সহযোগীসহ তাকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।

গত মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত রাজধানীর বাড্ডায় ‘টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ’ নামে তিনটি ভুয়া ওভারসিজ এজেন্সিতে অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার অন্যরা হলেন টুটুলের প্রধান সহযোগী এক সময়ের চা দোকানি তৈয়ব আলী, শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন, মেহেরপুরের মো. মারুফ হাসান, জাহাঙ্গীর আলম ও লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন, আবদুল্লাহ আল মামুন। অভিযানের সময় দুই নারীসহ চার ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ১০টি পাসপোর্ট, সাতটি ফাইল, চারটি সিল, ১৭টি মোবাইল, পাঁচটি রেজিস্টার, ব্যাংকের চেক বই, দুটি কম্পিউটার, তিনটি লিফলেট এবং নগদ ১০ হাজার টাকা। র‌্যাব বলছে, টুটুল ভুয়া ওভারসিজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে গত ৫-৭ বছরে কমপক্ষে অর্ধশত নারী পুরুষকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। এ ছাড়াও শতাধিক মানুষের সঙ্গে বিদেশ পাঠানোর নামে প্রতারণা করেছে চক্রটি।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, এই পাচারকারী চক্রের কিছু সদস্য দেশের বেকার ও অসচ্ছল যুবক-যুবতীকে সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নামে রাজি করিয়ে টুটুল ও তৈয়বের কাছে নিয়ে আসে। এরপর টুটুল ও তৈয়ব ভিকটিমদের বিদেশে পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভুয়া মানি রিসিট দিয়ে ২-৫ লাখ টাকা অগ্রিম নিতেন। পরে চক্রের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের কাছে নিজেদের উচ্চশিক্ষিত পরিচয় দিয়ে বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিত। চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদেরকে অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমের পাসপোর্ট বানানোর সব কাগজপত্র সংগ্রহ করত। পাসপোর্ট অফিসের দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়ে আনার পরে ভিকটিমের মনে আর কোনো সন্দেহ কাজ করত না। পরে ভিকটিমদের লোক দেখানো মেডিকেল সম্পন্ন করা হতো।

র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক বলেন, বৈধ ওভারসিজের মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে অর্ধশত নারী পুরুষকে চক্রটি সৌদি আরব (জেদ্দা ও রিয়াদ), জর্ডান ও লেবাননে পাঠিয়েছে। সেখানে চক্রটির আলাদা একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। ভুক্তভোগীরা দেশগুলোতে যাওয়ার পর, পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর নারীদের বিক্রি ও পুরুষদের কম বেতনে অমানবিক কাজ করানো হয়। অনেক সময় ভুক্তভোগীদের ছাড়ানোর কথা বলে তাদের পরিবারের কাছ থেকে ১-২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন টুটুল। আবার উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভনেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এক্ষেত্রে তৈয়ব আলী নিজেকে একটি স্বনামধন্য এয়ারলাইনসের ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দিতেন। প্রায় শতাধিক মানুষের কাছ থেকে অগ্রিম ২-৫ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারণাও করেছে চক্রটি। অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, এ চক্রের বিরুদ্ধে ২০-২৫ জন অভিযোগ করেছে। চক্রটির সঙ্গে বৈধ কোনো ওভারসিজ জড়িত কিনা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদিকে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করেছেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাব-৪-এর সিও বলেন, বৈধ কোনো জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। তবে বৈধতার আড়ালে কেউ যাতে মানব পাচার করতে না পারে সে জন্যই র‌্যাবের অভিযান। যারা মানব পাচারসহ অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে মানুষকে সর্বস্বান্ত করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর