বুধবার, ৬ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বন্যায় গৃহহারারা যাবে কোথায়

সিলেটে ৪০ হাজার, সুনামগঞ্জে ৪৫ হাজার বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত

প্রতিদিন ডেস্ক

বন্যায় গৃহহারারা যাবে কোথায়

বন্যায় সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার কাইক্কারপাড় গ্রামে বিধ্বস্ত বসতঘর -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্দশা কমেনি। বরং পানি কমার পর তারা পড়েছেন বড় বিপদের মুখে। দুর্গতরা আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে দেখতে পান তাদের সর্বনাশের আসল চিত্র।

বেশির ভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে অথবা ভেঙে পড়েছে। যেগুলো কোনোরকম দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোর অবস্থাও নড়বড়ে। ঝড়-তুফান হলে সেগুলোও ধসে পড়ার আশঙ্কার প্রহর গুনছেন দুর্গতরা। সর্বস্ব হারিয়ে এখন তারা দিশাহারা। তাদের জীবনের সব রং কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা বন্যা।

আমাদের সিলেট ও সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, বন্যায় সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলা ও পাঁচটি পৌরসভায় ৪০ হাজার ৯১টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েন ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবারের ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন।  

বন্যায় সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলায় অন্তত ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বানের পানির তোড় ও হাওরের ঢেউয়ের কারণে এ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানি সম্পূর্ণরূপে নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে বলে জানান জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

আমাদের সিলেট প্রতিনিধি শাহ্ দিদার আলম নবেল জানান, সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম আলীরগাঁও ইউনিয়নের হাতিরপাড়া গ্রামের লিয়াকত আলীর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নয় সদস্যের পরিবার। দিনমজুরের কাজ করে চলে তার দিন। টানাপোড়েনের সংসারে মাথাগোঁজার ঠাঁই বলতে ছিল কেবল একটা খড়ের তৈরি কাঁচাঘর। ১৫ জুন থেকে পানিবন্দি হয়ে পড়েন লিয়াকত আলী। পরদিন ঠিকতে না পেরে পরিবার নিয়ে ওঠেন এলাকার একটি আশ্রয় কেন্দ্রে। নয় দিন পর যখন লিয়াকত আলী যখন বাড়ি ফেরেন তখন দেখতে পান বসতঘরটি মাটিতে মিশে আছে। বানের পানি কেড়ে নিয়েছে তার আশ্রয়স্থল। আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরে লিয়াকত আলী যেন হয়ে পড়েন আশ্রয়হীন।

লিয়াকত আলীর মতো একই অবস্থা গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নোয়াগাঁওয়ের আবদুল কাদিরের। হাঁস লালন-পালন আর কামলা খেটে চালাতেন ছয় সদস্যের পরিবার। বন্যার স্রোতের তোড়ে আবদুল কাদিরের বসতঘরও বসে গেছে মাটিতে। আর বানের পানির সঙ্গে ভেসে গেছে আয়ের অবলম্বন হাঁসগুলো। খোলা আকাশকে ছাদ বানিয়ে এখন রোদ-বৃষ্টিতে মানবেতর দিনাতিপাত করছেন আবদুল কাদির। তার ভাষায়, ‘এর চেয়ে ভালো ছিল বন্যার পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। বন্যায় জীবিত রেখে গেছে, অথচ সর্বস্ব হারিয়ে পরিবার নিয়ে এখন বেঁচে থাকাটাও দায়। যেখানে দুমুঠো ভাতের জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ঘর বানানো তো দুঃস্বপ্ন।’

লিয়াকত আলী ও আবদুল কাদিরের মতো সিলেটে লাখো পরিবারের অবস্থা একই। এবারকার ভয়াবহ বন্যায় বেঁচে থাকার সব অবলম্বন হারিয়ে তারা এখন নিঃস্ব। বন্যার পানিতে ধসে পড়েছে ঘরবাড়ি। পানির তোড়ে ভেসে গেছে আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র। এক কাপড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠা বানভাসি মানুষ এখনো আছেন একইভাবে।

সিলেটে শতবর্ষী প্রবীণরাও বলছেন, তাদের জীবদ্দশায় এবারের মতো ভয়াবহ বন্যা দেখেননি। ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালের বন্যাকে সিলেটের ইতিহাসের বড় বন্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এবারকার বন্যার ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব ইতিহাস। গোটা জেলাজুড়ে এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি বলে স্বীকার করছে জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডও। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বন্যায় সিলেট জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভায় ৪০ হাজার ৯১টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮৩টি পরিবারের ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৪৩৩ জন মানুষ। জেলাজুড়ে বন্যা যখন ভয়াবহ রূপ নেয় তখন ৬১৪টি আশ্রয় কেন্দ্রে ওঠেন ২ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৪ জন বন্যার্ত। পানি কমার পর যখন তারা আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে যান, তখন তারা দেখতে পান তাদের সর্বনাশের দৃশ্য। বেশির ভাগ কাঁচা ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ভেসে গেছে অথবা ভেঙে পড়েছে। যেগুলো কোনোরকম খাঁড়া আছে সেগুলোর অবস্থাও নড়বড়ে। ঝড়-তুফান হলে সেগুলোও ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন ঘরের মালিকরা। 

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার ৩১৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছিলেন ২৫ হাজার ৫৭৯ জন। ঘরবাড়ি হারিয়ে অনেকে এখনো পরিবার নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করছেন।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন ৫ হাজার পরিবারকে এ সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। পরে এ খাতে আরও বরাদ্দ এলে ক্ষতিগ্রস্তদের ঘরবাড়ি নির্মাণে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে।

সিলেট সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকাগুলোতেও বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী জানিয়েছেন, নগরীতে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তালিকা প্রস্তুত হলে পুনর্বাসনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

আমাদের সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি মাসুম হেলাল জানান, কাইক্কারপাড়া সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের দেখার হাওরের পাড়ে অবস্থিত। সাজানো-গোছানো এ গ্রামটির চারদিকে এখন কেবলই ধ্বংসের ছাপ। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় আংশিক না হয় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে গ্রামটির অন্তত ৩০টি বসতঘর। সর্বস্ব হারানো এসব মানুষের কেউ আশ্রয় গেড়েছেন মহাসড়কের পাশে ঝুপড়িঘর বানিয়ে, কেউ আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী কিংবা স্বজনের বাড়িতে।

গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন জানান, ১৬ জুন দিনগত রাতে হু হু করে বাড়তে থাকে হাওরে পানি। দেখত দেখতে বুক সমান পানি হয় ঘরের ভিতর। সেইসঙ্গে তাণ্ডব চালাতে থাকে হাওরের প্রচণ্ড ঢেউ। ঢেউ আর বানের শ্রোতে একে একে বিধ্বস্ত হতে থাকে গ্রামের অন্তত ৩০টি বসতঘর। বন্যার পানি চলে গেলেও গ্রামটির বাড়ি বাড়ি এখন কেবল ঘরহারা মানুষের আহাজারি।

জানা যায়, ভয়াবহ বন্যা জেলাজুড়ে যে ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে, কাইক্কারপাড় গ্রাম যেন তারই এক বেদানাবিদুর প্রতিচ্ছবি। এমন দৃশ্য এখন হাওর ও নদীপাড়ের প্রায় প্রতিটি গ্রামে।

সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের তথ্যমতে, বন্যায় জেলার ১১টি উপজেলায় অন্তত ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বানের পানির তোড় ও হাওরের ঢেউয়ের কারণে এ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পানি সম্পূর্ণরূপে নেমে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। সরেজমিন শান্তিগঞ্জ উপজেলার কাইক্কারপাড়া গ্রামে গেলে দেখা হয় বন্যায় বিধ্বস্ত হওয়া পরিবারের অনেকের সঙ্গে। তাদের একজন হুসনা বেগম।  দীর্ঘদিনের তিলে তিলে গড়া সংসার মুহূর্তেই বিধ্বস্ত হয়েছে চোখের সামনে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই রক্ষা করতে পারেননি তিনি। মধ্যরাতে স্বামীসহ তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রতিবেশীর বাড়িতে। ঘর বিধ্বস্ত হওয়ার ১৬ দিনের মাথায়ও সেটি সেভাবেই পড়ে আছে। সামর্থ্যরে অভাবে নতুন ঘর বাঁধতে পারছেন না তারা। স্বামী-স্ত্রী ও তিন শিশু সন্তান অতি কষ্টে দিনযাপন করছেন। একই দশা ওই গ্রামের ফুলবানু-মাহমুদ দম্পতিরও। বানের পানির তোড়ে তাদের বসতঘরটি ভেঙে পড়েছে হাওরের পানিতে। সাত সদস্যের পরিবারটি এখন বাস্তুহারা।

আশ্রিত হয়েছেন অন্যের বাড়িতে। আর বসতঘর বিধ্বস্ত হওয়ায় অজুফা-রহিমের ১৬ দিন ধরে ঝুপড়িঘর বানিয়ে সন্তান-সন্ততি নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের আহছানমারা এলাকায়।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, জেলাজুড়ে বন্যায় বাস্তুহারাসহ ক্ষতিগ্রস্ত সব মানুষের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে। সেইসঙ্গে সর্বস্ব হারানো মানুষদের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে। সুনামগঞ্জে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বন্যায় জেলার অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, অনেকের টিনের বেড়া ভেঙে গেছে। প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, জরুরিভিত্তিতে এই ভেঙে যাওয়া ঘরের তালিকা তৈরি করে পাঠাতে। সেখান থেকে তাদের নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে। প্রয়োজনে টিনসহ অন্যান্য উপকরণ দেওয়া হবে। তিনি জানান, যাদের বাড়িঘর একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর