রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

কষ্ট বাড়ছে পোশাকশ্রমিকদের

♦ বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, বাড়ছে না মজুরি ♦ মজুরি বোর্ড গঠনের আশ্বাসের বাস্তবায়ন নেই ♦ ন্যূনতম ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি শ্রমিকদের

রুহুল আমিন রাসেল

কষ্ট বাড়ছে পোশাকশ্রমিকদের

ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছেই। তবু মজুরি বাড়ছে না। ফলে কষ্ট বাড়ছে পোশাকশ্রমিকদের। তথ্য বলছে, ওভারটাইম করে যেটুকু বাড়তি আয় হয়, তা-ও গিলে খাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন পোশাকশ্রমিকরা। এ ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠনে জুনে শ্রমিকদের দেওয়া আশ্বাসের বাস্তবায়ন হয়নি আজও। ফলে মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছেন পোশাকশ্রমিকরা।

জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মত হলো- বাংলাদেশে একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ২৭৬ টাকা। অর্থাৎ একজন শ্রমিকের শুধু খাদ্য বাবদ মাসিক ব্যয় ৮ হাজার ২৮০ টাকা। আর চার সদস্যের পরিবারের খাওয়ার খরচ বাবদ মাসে প্রয়োজন হবে ৩৩ হাজার ১২০ টাকা। এমন পরিস্থিতিতে পোশাকশ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন, ন্যূনতম মজুরি ২৪ হাজার টাকা নির্ধারণ, অন্তর্বর্তী সময়ে মহার্ঘ ভাতা, ভর্তুকি মূল্যে রেশন প্রদান, শ্রম আইনের ১৩(১) ধারার অপপ্রয়োগ করে শ্রমিক নিপীড়ন বন্ধের দাবি করছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাদের অভিযোগ, মজুরি বৃদ্ধির কথা বললেই শ্রম আইনের ১৩(১) ধারার অপব্যবহার করে, মিথ্য মামলা দিয়ে শ্রমিকদের ওপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। রাজধানীতে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে জুনের শুরুর দিকে সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের টানা দুই দিন ত্রিপক্ষীয় সভা হয়। সভায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠনের আশ্বাস দেওয়া হলেও আজও বাস্তবায়ন হয়নি। তৈরি পোশাক খাতে সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর নতুন মজুরিকাঠামো বাস্তবায়ন হয়। তাতে ন্যূনতম মজুরি ছিল ৮ হাজার টাকা। এ প্রসঙ্গে সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কর্মক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে, শারীরিক পুষ্টি ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৪ হাজার টাকা ঘোষণা করতে হবে। অন্তর্বর্তী সময়ে মহার্ঘ ভাতা ও ভর্তুকি মূল্যে রেশন প্রদান করতে হবে। গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) কার্যকরী সভাপতি কাজী রুহুল আমিন বলেন, অবিলম্বে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে। পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২০ হাজার টাকা ও মহার্ঘ ভাতা ৫০ শতাংশ নির্ধারণ করতে হবে। শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখতে দ্রুত নতুন মজুরি নির্ধারণের বিকল্প নেই। জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘নতুন মজুরি বোর্ড গঠনে সরকার ও মালিকদের কাছে দাবি জানিয়েছি। দেশের সার্বিক দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নতুন মজুরিকাঠামো গঠন করতে হবে। বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।’

ন্যূনতম মজুরিকাঠামোর নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর শ্রমিকের মূল মজুরি ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করার কথা মালিকদের। অথচ তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৯ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এতে জুলাইয়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এদিকে ৬ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার। এরপর নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম আরেক দফা বেড়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে চালের দাম অন্তত ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। আটা-ময়দার দাম বেড়েছে ৫৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। সয়াবিন তেলের দামও বেড়েছে প্রায় ৩৮ থেকে ৫০ শতাংশ। ডিমের দাম বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। এ ছাড়া মাছ, মাংস, সবজি, তরিতরকারি সব পণ্যের দামই বেড়েছে। এখনো বাড়ছে। বাজারে এখন ৫৫ টাকার নিচে কোনো চাল পাওয়া যায় না। সরু চালের কেজি বেড়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা। বাজারে খোলা সাদা আটাও ৫০ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে উঠেছে। আর ২ কেজি প্যাকেটজাত আটার দাম উঠেছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকায়, যা এক বছর আগে ছিল ৭০-৭৫ টাকা। মসুর ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ। আলুর বাজারও চড়া। লবণও কেজিতে বেড়েছে ১০ টাকা। কাঁচা মরিচ তো ট্রিপল সেঞ্চুরির পথে। ফলে মাছ-মাংস বাদ দিয়ে ডিম ভাজি, আলুভর্তা, ডাল-ভাতও যেন এখন বিলাসী খাবার। অথচ মানুষের আয় বাড়েনি মোটেও। ফলে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন পোশাকশ্রমিকদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষ।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘর ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য কেনা, সন্তানের পড়ালেখার খরচ, যাতায়াত, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের বিল হিসাব করলে ঢাকার আশপাশ এলাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা।

বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও পোশাকশ্রমিকদের বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ চ্যানেল দ্য গার্মেন্ট ওয়ার্কার ডায়েরিসের (জিডব্লিউডি) যৌথ জরিপ প্রকাশিত হয় ১৯ মে। জরিপে পোশাকশ্রমিকদের এ সংকটময় পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিকদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে এতে। তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক খাতে রপ্তানি আদেশ অনেক বেড়েছে। সেই সঙ্গে কাজও বেড়েছে। ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন উদ্যোক্তারা। এতে শ্রমিক সংকট দেখা দিচ্ছে। প্রয়োজনীয়-সংখ্যক শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে শ্রমিকদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করাতে হচ্ছে।

জরিপে দেখা যায়, করোনা মহামারির প্রভাব কাটিয়ে কাজের চাপ অনেক বেড়েছে পোশাক খাতে। এমনকি আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে কর্মঘণ্টা বেশি শ্রমিকদের। এখন গড়ে ১০ ঘণ্টা কাজ করছেন তারা। মূল বেতনের সঙ্গে ওভারটাইম হিসেবে আয় বেড়েছে। তবে তাদের বাড়তি এ আয় কেড়ে নিচ্ছে মূল্যস্ফীতি। এতে তাদের প্রকৃত আয় কমেছে, কমেছে ক্রয়ক্ষমতা। জরিপ থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিলের লকডাউনের পর থেকেই শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা বেড়েছে। এতে বেতনের সঙ্গে ওভারটাইমসহ শ্রমিকদের আয়ও বেড়েছে। তবে যে পরিমাণ আয় বেড়েছে, এর চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে চালের মূল্য। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত সময়কে তুলনা করা হয়েছে। এ সময়ে শ্রমিকরা যে ধরনের চাল কেনেন সেগুলোর দর বেড়েছে ১৩ শতাংশ। আর বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ৩ হাজার টাকার ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। আর পণ্যের দর বৃদ্ধিসহ অন্যান্য ব্যয় তো আছেই।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর