বাসটির নিবন্ধন নম্বর ঢাকা মেট্রো-ব ১২-০৭৯৯। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বারিধারায় চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসটির নাম ‘গ্রিন ঢাকা’ হলেও চলাচলের সময় আশপাশের এলাকা অন্ধকার করে ফেলছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায়। কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী ফিটনেসবিহীন এমন অসংখ্য যানবাহনে সয়লাব রাজপথ। দূষিত করছে বাতাস। ফলে বছরের অধিকাংশ সময় বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে থাকছে ঢাকার নাম। বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অক্টোরের ৩১ দিনের মধ্যে মাত্র তিন দিন স্বাস্থ্যকর ছিল এই মহানগরীর বাতাস।
গতকাল রাজধানীর সড়কে সরেজমিন কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী অসংখ্য যানবাহনের দেখা মিলেছে। প্রতি ১০-১২টি যানবাহনের মধ্যে অন্তত একটিকে দেখা গেছে কালো ধোঁয়া ছাড়তে। যাত্রীবাহী বাসের মধ্যে ঢাকা মেট্রো-ব সিরিয়ালের ১১-৯৫৬৬ নম্বরের ভূইয়া পরিবহন, ১৪-৯৫০৮ নম্বরের বলাকা, ১৫-৪৮২১ নম্বরের ভিক্টর, ১১-৮৩১৫ নম্বরের ভিক্টর, ১৫-৪২৬৭ নম্বরের আজমেরী গ্লোরী, ১৪-৯৫৮৪ নম্বরের গাজীপুর পরিবহন, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলাচলকারী ১২-০৮৯০ নম্বরের সৌখিন এক্সপ্রেসসহ অনেক বাস থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। উত্তরায় আশপাশের এলাকা অন্ধকার করে ছুটে চলতে দেখা গেছে ঢাকা মেট্রো-ন ১৬-৮৮৮৮ নম্বরের পিকআপটিকে। একই সময়ে আরও একটি ছোট পিকআপকে কালো ধোঁয়া ছাড়তে দেখা গেলেও ছিল না নম্বরপ্লেট। পরিবেশ দূষণকারী অনেক যানবাহনের নম্বরপ্লেট ঝাপসা থাকায় শনাক্ত করা যায়নি। দুপুর ২টার দিকে প্রগতি সরণি দিয়ে জ্বালানি তেল নিয়ে ছয়-সাতটি তেলবাহী ট্যাংকলরি যেতে দেখা যায়। অধিকাংশই ঢাকার বাইরে নিবন্ধিত। এর মধ্যে পিরোজপুর-ঢ ৪১-০০৮৬, যশোর-ঢ ৪১-০০৪০, পাবনা-ঢ ০৮-০০১৮ নম্বরের লরিগুলো থেকে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। এদিকে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দূষণ, বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি, চার বছরের উন্নয়ন কর্ম ১০ বছরে শেষ না হওয়া, দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করে উন্নয়নকাজের কারণে রাজধানী ঢাকা প্রায়ই পৃথিবীর শীর্ষ দূষিত শহরের তকমা অর্জন করছে। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায়ও ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ২.৫) ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৬০ মাইক্রোগ্রাম, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেওয়া সীমার চেয়ে ১২ গুণ বেশি। গত অক্টোবরের ৩১ দিনের মধ্যে শুধু ১০, ১১ ও ২৪ তারিখ ঢাকার বাতাস ছিল স্বাস্থ্যকর। এই তিন দিনই ছিল বৃষ্টিপাত। এর মধ্যে ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে সারা দিনই বৃষ্টি ছিল। বাকি দিনগুলোর মধ্যে ১০ দিন বাতাস ছিল সহনশীল, ছয় দিন বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর ও ১২ দিন ছিল পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর। এদিকে রাজধানীর বাতাস দূষিত করে ফিটনেসবিহীন যানবাহন দাপিয়ে বেড়ালেও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেই বললে চলে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে ৩ হাজার ৩৮টি মামলা ও ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৯০ টাকা জরিমানা করে। তবে ফিটনেস না থাকায় ডাম্পিং করা হয়নি কোনো যানবাহন। বিআরটিএর হিসাব মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৬ হাজার ৯৫৪টি। ঢাকাতেই নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ১৯ লাখ ২১ হাজার ২৭৩টি। জানা গেছে, সারা দেশে ১৮ হাজার ৪৫২ বাস এবং ১০ হাজার ২৯১ মিনিবাসের ফিটনেস নেই। অন্যান্য ছোট-বড় যানবাহন মিলিয়ে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৪৩২টি যানবাহন ফিটনেস ছাড়াই চলাচল করছে। এসব যানবাহনের একটা রাজধানীতেই চলছে। একটা অংশ বাইরে থেকে প্রতিদিন মালামাল নিয়ে রাজধানীতে ঢুকছে। বিস্ময়কর বিষয় হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিনিয়ত যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও ফিটনেস সনদের আবেদন ও ইস্যু কমেছে। জানা গেছে, ফিটনেস না পাওয়ার আশঙ্কায় অনেকে ফিটনেসের আবেদন করছেন না। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে নতুন নিবন্ধিত হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩০টি যানবাহন। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসেই নিবন্ধিত হয়েছে ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬টি যানবাহন। তবে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ফিটনেস ইস্যু ও নবায়ন করা হয়েছে ২০২১-২২ অর্থবছরে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৬০টি ফিটনেস সনদ ইস্যু ও নবায়ন হলেও ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার ৩২২টি। এদিকে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮-এর ২৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ফিটনেসের অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ বা ক্ষতিগ্রস্ত, রংচটা, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া নির্ধারিত রং পরিবর্তন করে জরাজীর্ণ, বিবর্ণ ও পরিবেশ দূষণকারী কোনো মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধে ছয় মাসের কারাদন্ড বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডই হতে পারে। তবে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই পরিবেশের দূষণ ঘটিয়ে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। সম্প্রতি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে জরাজীর্ণ ও ফিসনেসবিহীন গাড়ির ত্রুটি না সারালে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানার কথা জানিয়েছে বিআরটিএ। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, বাসের ফিটনেস সনদ দেওয়ার আগে ৬০টি উপাদান পরীক্ষা করতে হয়। যার জন্য জনবল রয়েছে মাত্র ১২৫ জন। এ কারণেই সব গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা তাদের পক্ষে কঠিন। এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর রোড সেফটি উইংয়ের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে সারা বছরই অভিযান চলে। নতুন করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে গাড়ির ফিটনেস না ঠিক করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফিটনেস ছাড়া গাড়ি রাস্তায় নামলে মামলা-জরিমানা ছাড়াও ডাম্পিংয়ে পাঠানো হবে।