সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
আবাদ নিয়ে বিপাকে কৃষক

তিস্তা শুকিয়ে ধু-ধু বালুচর

কঠিন হয়ে পড়েছে সেচ কার্যক্রম পেশা পরিবর্তন করছেন জেলেরা

রেজাউল করিম মানিক, লালমনিরহাট

তিস্তা শুকিয়ে ধু-ধু বালুচর

সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে আসা এক সময়ের চিরযৌবনা আলোচিত নদী তিস্তা। এ নদী ঘিরে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রামসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অসংখ্য জনবসতি। সৃষ্টি হয়েছে ভাওয়াইয়া সুর। কিন্তু তিস্তার এখন আর সেই চিরচেনা রূপ নেই। প্রমত্তা তিস্তা এখন হারাতে বসেছে তার চিরযৌবনা রূপ। নদীটি এখন ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। এবার জানুয়ারিতেই পানিশূন্য হয়ে পড়েছে তিস্তা। নদীর বুকে জেগে ওঠা বালুচর জানিয়ে দিচ্ছে তিস্তার পিপাসার আর্তনাদ। এতে নদী এলাকার জেলে ও কৃষিজীবী লাখো মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তিস্তা নদীর নাব্য এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, চলতি মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে রবি মৌসুমে চাষাবাদের টার্গেটও কমিয়ে আনা হয়েছে। এ বছর উত্তরের পাঁচ জেলার ১৪টি উপজেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নদী-তীরবর্তী লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিস্তা নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে দুই কূল উপচে বিস্তীর্ণ এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। ভেসে যায় বসতভিটাসহ ঘরবাড়ি।

অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় নদী-তীরবর্তী এলাকায় সেচ সংকটের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপে পানি মেলে না। এ ছাড়া চরাঞ্চলের জমিতে আলুসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করেও পানির অভাবে সেচ দিতে না পারায় কৃষকদের বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনতে হয়। তিস্তা পাড়ের একাধিক কৃষক বলেন, ব্যারাজের উজান ও ভাটিতে বিশাল বিশাল চর জেগেছে। দেখে মনেই হয় না- এটি তিস্তা নদী। আবাদ করতে গিয়ে পড়েছি চরম বিপাকে। তিস্তায় পানি না থাকায় শ্যালোচালিত পাম্প দিয়ে চরের জমি আবাদ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় লাভ তো দূরের কথা। খরচ তোলাই দায়। আমরা তিস্তা পাড়ের কৃষকরা বাঁচি ক্যামনে। বন্যা যেমন আমাদের বিপদ, খরাতেও মরণ। এদিকে জেলেরা বলেন, বর্ষা শেষ না হতেই তিস্তায় পানি নেই। মাছ ধরে জীবিকা চালানো আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে।

নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপলসের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘অন্যান্য নদীর তুলনায় তিস্তা অত্যন্ত ভালো নদী। এখানে দখল-দূষণ তুলনামূলক কম। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে একতরফাভাবে ভারত পানি প্রত্যাহার করায় নদীটি দিন দিন মরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় নদীর পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের লালমনিরহাটের সভাপতি ড. শফিকুল ইসলাম কানু বলেন, ‘রংপুর অঞ্চলের প্রাণ তিস্তা নদী। অথচ সেই নদীটিই এখন প্রাণ হারাতে বসেছে। পানির ন্যায্য হিস্যার দাবি নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছি এবং তা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি সরকারের পরিকল্পনায় থাকা তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নও দ্রুত করা উচিত বলে মনে করছি।’

প্রতিদিনই কমছে পানি। এদিকে আর এক মাস পরেই সেচনির্ভর ইরি-বোরোর চাষাবাদ শুরু হবে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে ধানের শীষ হেলে না পড়া পর্যন্ত সেচ দিতে হয়। সে পর্যন্ত বোরো আবাদের জন্য সেচ অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের সেচের আওতাভুক্ত এলাকার কৃষকদের জন্য তিস্তার সেচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষুনি তিস্তা পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হওযার ঝুঁকি রয়েছে।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশিদীন ইসলাম জানান, সেচপ্রকল্পের পানিসহ তিস্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে কমপক্ষে ১ লাখ ২০ হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন। অথচ বর্ষা শেষ না হতেই গত ১০ দিনে গড়ে ব্যারাজের মূল গেটের পানি প্রবাহ রয়েছে ২৫ হাজার ৩০০ কিউসেক। যা দিয়ে তিস্তা ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম শুরু করা কষ্টকর হবে।

সর্বশেষ খবর