সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

সাত বছর পর জানা গেল বাবাই খুনি

নিজস্ব প্রতিবেদক

টাঙ্গাইলের কালিহাতীর গড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল কুদ্দুছ খাঁ। তিন মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসারই ছিল তার। কুদ্দুছের স্বপ্ন ছিল মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করে ভালো জায়গায় বিয়ে দেবেন। মেয়েদের মধ্যে পারুল আক্তার (১৫)  দেখতে বেশ সুন্দর ও মেধাবী হওয়ায় তাকে নিয়ে কুদ্দুস খাঁর প্রত্যাশা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পারুল নবম শ্রেণিতে থাকতে পাশের এলাকার নাছির উদ্দিন ওরফে বাবুর (১৯) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। পরিবার রাজি না হওয়ায় পালিয়ে বিয়ে করে বাবুর সঙ্গে পারুল নতুন জীবন শুরু করে। এদিকে মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ জন্ম নেয় কুদ্দুসের মধ্যে। তিনি জামাতাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার চিন্তা করেন। পালিয়ে বিয়ে করার পর অপহরণের অভিযোগে জামাতার বিরুদ্ধে জিডি দায়ের করেন। এতেও তার মন ভরেনি। ক্ষোভ মেটাতে নিজ মেয়েকে জয়পুরহাটে নিয়ে পরিকল্পিকভাবে খুন করে জামাতার বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেন।

কিন্তু হত্যাকান্ডের সাত বছর পর নিজ মেয়েকে খুনের দায়ে কুদ্দুছ নিজেই ফেঁসে গেছেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে হত্যার সহযোগী বন্ধুসহ ধরা পড়েছেন কুদ্দুছ। এরপর হত্যাকান্ডের বর্ণনা তুলে ধরে দিয়েছেন স্বীকারোক্তিও। গতকাল দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, ঘটনার শুরু ২০১২ সালে। ওই বছর টাঙ্গাইলের কালিহাতীর গড়িয়া গ্রামের কুদ্দুছের মেয়ে পারুল পার্শ্ববর্তী এলাকার বাবুকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করেন। এই ঘটনায় কুদ্দুছ ২০১২ সালে কালিহাতী থানায় জিডি করেছিলেন। উভয়ের পরিবার বিয়ে মেনে না নেওয়ায় তারা ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়ায় বসবাস শুরু করেন। নাসির উদ্দিন চাকরি নেন পোশাক কারখানায়। নানা কারণে তাদের পারিবারিক অশান্তি চলতে থাকে। পারুল তার বাবাকে ফোন করে অশান্তির কথা জানায়। বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। অপমানবোধ ও প্রচ- রাগও ছিল। একপর্যায় ভালো ছেলে দেখে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখান বাবা। পিবিআই প্রধান বলেন, ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই পারুলের স্বামী নাসির তার নানিকে দেখতে যায়। সেই সুযোগে বাবার দেওয়া আশ্বাসে পারুল পরদিন তার বাবাকে ফোন করে টাঙ্গাইলে চলে যায়। ১৯ জুলাই পারুলের স্বামী বাবু শ্বশুর কুদ্দুছ খাঁর বিরুদ্ধে তার স্ত্রীকে বাবার বাড়ি পালিয়ে যেতে প্ররোচণা দেওয়ার অভিযোগে আশুলিয়া থানায় জিডি করেন। সেদিন কুদ্দুছ খাঁ পারুলকে নিজের বাড়িতে না নিয়ে প্রথমে ভূঞাপুরে তার বন্ধু মোকাদ্দেছ মন্ডলের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যান জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় একটি নদীর পাশে। সেখানে রাতের অন্ধকারে পারুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে বন্ধু মোকাদ্দেছের সহযোগিতায় গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন কুদ্দুছ। আগে ১২ বছর জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকায় থাকায় ওই এলাকার অনেক কিছু চেনাজানা ছিল কুদ্দুছের। এজন্য মেয়েকে নিয়ে তুলসী গঙ্গা নদীর পাশে নির্জন জায়গায় যান। পিবিআই কর্মকর্তা বনজ বলেন, গত শুক্রবার আদালতে কুদ্দুছের ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তির বর্ণনা অনুসারে, পারুল, কুদ্দুস ও তার বন্ধু মোকাদ্দেছ রাতের অন্ধকারে নদীর পাড় ধরে ধরে হাঁটতে থাকেন। এক পর্যায়ে কুদ্দুছ মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এরপর মেয়ের ওড়না ২ টুকরা করে এর এক টুকরা দিয়ে তার হাত বাঁধেন। মোকাদ্দেছ আরেক টুকরা দিয়ে পারুলের পা বেঁধে ফেলেন। এ অবস্থায় কুদ্দুছ গলায় গামছা পেঁচিয়ে মেয়েকে হত্যা করেন। পরে পারুলের লাশ নদীতে ফেলে টাঙ্গাইলে ফিরে আসেন। ওই বছরের ৪ আগস্ট পারুলের স্বামী নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে টাঙ্গাইলের আদালতে মামলা করেন কুদ্দুছ। মামলার পর কালিহাতী থানা পুলিশ তদন্ত করে পারুলের প্রেম করে বিয়ে করার সত্যতা পায়। কিন্তু ঘটনাস্থল তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত বলে প্রতিবেদন দাখিল করে। এ অবস্থায় মামলার বাদী কুদ্দুছের বারবার নারাজির পরিপ্রেক্ষিতে টাঙ্গাইল সিআইডি ও পিবিআই তদন্ত করে একই প্রতিবেদন দেয়। শেষ পর্যন্ত আদালত বিচারিক তদন্ত করে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাদী ঢাকার আদালতে মামলা করলে প্রতিকার পেতে পারেন। এরপর গত বছরের ২৭ নভেম্বর কুদ্দুছ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পারুলকে যৌতুকের জন্য মারপিট করে হত্যার অভিযোগে আরেকটি মামলার আবেদন করেন। গত ৩০ নভেম্বর আদালত আশুলিয়া থানাকে মামলা গ্রহণ এবং ঢাকা জেলা পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়। আশুলিয়া থানায় মামলা দায়ের করা হলে ঢাকা জেলা পিবিআই তদন্ত শুরু করে। এই মামলার পর পিবিআই পারুলের স্বামী বাবুকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠায়। ডাকা হয় বাবা কুদ্দুছকে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য দিতে থাকেন। একপর্যায়ে নিজ হাতে মেয়েকে হত্যার কথা স্বীকার করেন। এ ঘটনায় কুদ্দুছের বন্ধু ও এই হত্যাকান্ডের সহযোগী মোকাদ্দেছকেও গ্রেফতার করা হয়।

সর্বশেষ খবর