রবিবার, ২১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

আর চাষ হবে না ব্রি ধান ২৮ ও ২৯

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

আর চাষ হবে না ব্রি ধান ২৮ ও ২৯

ফসলের মাঠে আর চাষ হবে না ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বোরো আবাদ থেকে কৃষকের প্রিয় এই দুই জাতের ধানের বীজ প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সভায়। সুপারিশে চলতি বোরো মৌসুম থেকে ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের বীজ সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে; দুই বছরের মধ্যে বীজ সংগ্রহ কার্যক্রম শূন্যে নামিয়ে আনতে একটি রূপরেখা তৈরির কথা বলা হয়েছে; বিকল্প জাত হিসেবে বঙ্গবন্ধু, বিনা-২৫-সহ ব্রি ৮৯, ৯২, ৯৭, ৯৯ ইত্যাদি আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করার সুপারিশ করা করা হয়েছে। বোরো মৌসুমে ধানবীজ সরবরাহ সংক্রান্ত এক সভায় এসব সুপারিশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। গত ১৬ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বীজ অনু বিভাগের মহাপরিচালক ও জাতীয় বীজ বোর্ডের সচিব মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলা। ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের কাছে এ দুটি ধানের বীজ অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই ধানের চালের চাহিদাও বেশি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ মৌসুমে ৩৫ লাখ হেক্টর জমিতে উফশী বোরো ধানের আবাদ হয়; এর মধ্যে ৫০ ভাগের বেশি প্রায় ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ এর চাষ করেন কৃষকেরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান কৃষকের কাছে এতই জনপ্রিয় যে বোরো মৌসুমে অর্ধেকেরও বেশি এই ধানের আবাদ হচ্ছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে এই দুটি জাতের আবাদ বেশি হওয়ার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা কমে গেছে। এর ফলে ধানের ছত্রাকজাতীয় রোগ ব্লাস্টের সংক্রমণ বেড়েছে। গত কয়েক বছর ধরে হাওরাঞ্চলসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকা থেকেই এই দুটি জাতের ধানে ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ বাড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতেই জনপ্রিয় এই দুটি জাত প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল বোরো ধান নিয়ে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, অনেক জায়গায়ই চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা চাচ্ছি খুব দ্রুত ব্রি-২৮ মাঠ থেকে তুলে নিতে। কৃষকরা যাতে এ ধান আর চাষ না করেন, সে জন্য তাদের নিরুৎসাহিত করছি। তাদের অন্য জাত চাষ করতে বলছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বোরোর বীজ সরবরাহ সংক্রান্ত সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণীতে উল্লিখিত সিদ্ধান্তগুলো ছিল- ব্রি ধান কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৫০ ভাগ কমানো যেতে পারে; পরবর্তী বছরে ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের বীজ সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা শূন্যে নামিয়ে আনা যেতে পারে; ব্রি ধান ২৮ এর বিকল্প হিসেবে ব্রি ৬৮, ৮১, ৮৬, ৮৮, ৯৬, ১০১, ১০৪, ১০৫, বঙ্গবন্ধু ধান ১০০, ব্রি হাইব্রিড ধান ৩, ৫ ও ৮ আবাদ করা যেতে পারে; এ ছাড়া ব্রি ধান ২৯ এর বিকল্প হিসেবে ব্রি ৮৯, ৯২, ৯৭, ৯৯, ১০২ এবং লবণাক্ত এলাকায় বিনা ১০ ও অলবণাক্ত এলাকায় বিনা ২৫ জাতের আবাদ বৃদ্ধির পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, সভায় যে সুপারিশগুলো গৃহীত হয়েছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তা সিড প্রমোশন কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে ২৮ মে ওই সভাটি হওয়ার কথা রয়েছে। ওই সভাতেই ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান দুটি প্রত্যাহারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে।  তবে তড়িঘড়ি করে বোরো আবাদ থেকে কৃষকের প্রায় এই দুটি জাতের ধান প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিলে তা কৃষকের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে সভার কার্যবিরণীতে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ রাইস রিসার্স ইনস্টিটিউট (ব্রি)-এর প্রতিনিধি সভায় জানান, ব্রি উৎপাদিত জাতগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধী কোনো জাত পাওয়া যায়নি। অনুকূল পরিবেশ পেলে সব জাতেই বিস্তর ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। ফলে হঠাৎ করে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯ এর আবাদ কমানো যাবে না।  বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)-এর প্রতিনিধি সভায় জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উফশী বোরো আবাদে ৩৭ হাজার ২৩৪ মেট্রিক টন ধানবীজ সরবরাহ করা হয়, যা মোট সরবরাহকৃত বোরো ধান বীজের ৫৮ শতাংশ। অপরদিকে বোরো আবাদের পর এ মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে ব্রি ২৮ জাতের ৮ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন বীজ এবং ব্রি ২৯ জাত থেকে ১৮ হাজার ৭৩০ মেট্রিক টন বীজ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এখন সুপারিশ অনুযায়ী চলতি মৌসুম থেকে বীজ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হঠাৎ ৫০ ভাগ কমানো হলে আগামী মৌসুমে বোরো আবাদে বীজের সংকট দেখা দিতে পারে। বিএডিসি প্রতিনিধি বলেন, গত মৌসুমে ব্রি ধান ২৮ যে পরিমাণ বীজ সংগ্রহ করা হয়েছিল এবার তার থেকে ১০ হাজার মেট্রিক টন কম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। উপরন্তু বীজ সংগ্রহের জন্য কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে এবং এরই মধ্যে ২৮ ও ২৯ জাত মিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রার ৪৫ শতাংশ বীজ সংগ্রহ হয়েছে। এ অবস্থায় চুক্তিবদ্ধ চাষিদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার কম বীজ সংগ্রহ করলে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং চুক্তির বরখেলাপ হবে। বিএডিসির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ সাজ্জাদ এনডিসি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হাওরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ হওয়ায় ব্রি ২৮ ও ২৯ জাত প্রত্যাহারের চিন্তাভাবনা চলছে। বিকল্প হিসেবে বঙ্গবন্ধু ১০০, বিনা ২৫ এবং ব্রি ৮৯, ৯২ ইত্যাদি জাতের বীজ কৃষকদের মধ্যে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে যে নির্দেশনা আসবে পরবর্তীতে সেভাবেই বীজ সংগ্রহ ও সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। জাতীয় বীজ বোর্ডের সচিব মো. আবু জুবাইর হোসেন বাবলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, যেহেতু ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের ধান কৃষকের কাছে খুবই জনপ্রিয়, তাই হঠাৎ করে এটি প্রত্যাহার সম্ভব হবে না। এ ছাড়া এই দুই জাতের বিকল্প হিসেবে পর্যাপ্ত ভিত্তি বীজও সরকারের হাতে নেই। এ জন্য আগামী দুই বছরের মধ্যে ব্রি ২৮ ও ২৯ জাতের বীজ কৃষকদের কাছ থেকে তুলে নিয়ে বিকল্প জাতের ধানের বীজ সরবরাহের সুপারিশ করা হয়েছে।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর