ময়মনসিংহ জেলা সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরবর্তী উপজেলার নাম মুক্তাগাছা। এ মুক্তাগাছায় ছিলেন ষোলো হিস্যার জমিদার। ১৬ জন জমিদার মুক্তাগাছা অঞ্চল শাসন করতেন। মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী ছিলেন এর মধ্যে অন্যতম। তারই দত্তক পুত্র মহারাজ শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। মুক্তাগাছার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে এ রাজবাড়িটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রায় ১০০ একর জমির ওপর রাজ পরিবারের তিনটি বাড়ির অবস্থান। এক নম্বর বাড়িটি ছিল মহারাজ সূর্যকান্তের। সম্মুখভাগের একতলা ভবনটি বেশ উঁচু ও উপরিভাগে নানা কারুকার্যখচিত রয়েছে। লোহার পাত ও কাঠের পাটাতনের ওপর এর ছাদ নির্মিত। এর চারপাশে ব্যবহৃত লোহার পাতেও রয়েছে নানা নকশাখচিত।
এ রাজবাড়ির ঠিক মাঝখানে রয়েছে শ্বেতপাথরের স্বয়ংক্রিয় ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ, পাশেই নান্দনিক কারুকার্যখচিত রাজ রাজেশ্বরী মন্দির। পেছনে আছে রাজ কোষাগার, টিন ও কাঠের সুরম্য দ্বিতল রাজপ্রাসাদ। রাজবাড়ির সম্মুখভাগের বিশাল লোহার ফটক পেরুতেই সুউচ্চ করিডর। এর একপাশে ছিল রাজদরবার ও দ্বিতল কাচারিঘর। আর এক পাশে লাইব্রেরি। করিডরের দুই পাশে ছিল হাতির ছয়টি মাথার ওপর শিকার করা বাঘের নমুনা। রাজবাড়িলাগোয়া বিশাল পুকুর। মন্দির ও যুগল মন্দিরসহ সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর এ বাড়িটি ঘুরে দেখলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে পুরাতন আদল ধরে রেখে নতুন করে সাজানো হয়েছে এককালে দুর্দ প্রতাশালী জমিদারদের আবাসস্থল মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ি। জমিদারবাড়িকে ঘিরে পর্যটন জোন গড়ে তোলার দাবি এলাকাবাসীর।
ইতিহাসখ্যাত মুক্তাগাছা রাজপরিবার ও ভূস্বামীদের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য ১৭২৭ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অনুগ্রহ লাভ করেন। তিনি জমিদারি সদর দপ্তর বিনোদবাড়িতে স্থাপন করেন। পলাশীর যুদ্ধের পরপরই আনুমানিক ১৭৬০ সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর পর ছেলে রামরাম, হরেরাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম এ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বগুড়ার অধিবাসী। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী জমিদারিত্ব নিয়ে এ এলাকায় আসার সময় মুক্তারাম কর্মকার নামের এক দরিদ্র প্রজা পিতলের সুবৃহৎ একটি দ্বীপধার (গাছা) দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। রাজা খুশি হয়ে এক সময়ের বিনোদবাড়ি মুক্তারামের নামের সঙ্গে প্রদত্ত গাছার সঙ্গতি রেখে এ এলাকার নাম দেন মুক্তাগাছা। প্রজাদের ওপর জমিদারদের নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রজাবৎসলের ইতিহাস। জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে ছাতা মাথায় দিয়ে কোনো প্রজা গেলে জমিদারদের হুকুমে পাইক-বরকন্দজরা তাদের ধরে এনে চাবুক মেরে এই দুঃসাহসের সাজা দিত। এহেন শাস্তির ভয়ে প্রজারা জুতা, ছাতা বগলে নিয়ে রাজবাড়ির আঙিনা অতিক্রম করত।