গোলাম রাব্বানীর শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ সম্পূর্ণ অচল। তবু থেমে থাকেননি। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের কোডম্যানবিডির তিনটি ব্যাচে অংশ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি ফাইভার মার্কেটপ্লেসে লেভেল-২ সেলার হিসেবে ৩০০টিরও বেশি অর্ডার সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন...
শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ সম্পূর্ণ অচল। দাঁড়ানো তো দূরের কথা, ঠিকমতো বসতেও পারেন না গোলাম রাব্বানী। দুই পা অচল থাকায় ঘরের একটি কাঠের চৌকির পাশে একটি তক্তায় কম্পিউটার সরঞ্জাম রেখে দিনরাত কাজ করেন। ২৩ বছর বয়সি এ যুবক নিজের অদম্য ইচ্ছা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে গড়ে তুলেছেন সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরের চিংগড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. বাবুল খানের একমাত্র ছেলে কখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। এমনকি পা রাখেননি স্কুলেও। কিন্তু পেয়েছেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সম্মাননা। তাঁর আয় দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ টাকার ঋণ শোধ করেছেন। একটা সময় পরিবার যাকে বোঝা মনে করত সেই এখন পরিবারের একমাত্র ভরসা। শুধু নিজের নয়, এখন পুরো পরিবারের দায়িত্বই কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। জানা গেছে, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের কোডম্যানবিডির তিনটি ব্যাচে অংশ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি ফাইভার মার্কেটপ্লেসে লেভেল-২ সেলার হিসেবে ৩০০টিরও বেশি অর্ডার সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। ঋণ নিয়ে একটি কম্পিউটার কিনে দিনরাত ১০-১৫ ঘণ্টা পরিশ্রম করে সফলতা পেতে থাকেন। ২০২৪ সালে এক ক্লায়েন্টের সহযোগিতায় আধুনিক প্রযুক্তি হুইলচেয়ার ক্রয় করেন, যা ব্যাটারিচালিত। তিনি এখন কাজ করছেন ডিজিটাল মার্কেটিং মুক্ত পেশাদার হিসেবে। তবে তাঁর এখন সবচেয়ে প্রয়োজন একটি নিরাপদ বসতঘর, স্বাস্থ্যসম্মত রুম, যেখানে বসার উপযোগী চেয়ার এবং ফ্রিল্যান্সিং কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। রাব্বানীর জীবনযুদ্ধ থেকে শেখার আছে অনেক। তিনি অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন সমাজের অন্য হতাশ মানুষের কাছে। তিনি জানান, কিছু করার ইচ্ছা থাকলেই পারা যায়। ২০২১ সাল পর্যন্ত নিজেকে অর্থহীন মনে করতেন এই চলনশক্তিহীন যুবক। কিন্তু একসময় নিজেকে নিয়ে কিছু করার দৃঢ় সংকল্প নেন। ১৯ মাসে নিজেই কোরআনের হাফেজ হয়েছেন। এরপর ফ্রিল্যান্সিংয়ের স্বপ্ন নিয়ে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন। রাব্বানী জানান, তাঁকে কেউ বড় একটি ট্রেনিং সেন্টার করে দিলে তিনি এজেন্সি খুলে তরুণদের বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে সাহায্য করবেন। গোলাম রাব্বানীর মা আঁখি নূর বেগম বলেন, ‘আমার তিন সন্তান। এর মধ্যে গোলাম রাব্বানী দ্বিতীয় সন্তান। বড় বোন সুইটি আক্তারও শারীরিক প্রতিবন্ধী। আর ছোট বোন আফসানা (১০) স্বাভাবিক। দরিদ্র টেইলার্স বাবার সামান্য আয়ে চলত তাদের সংসার। নুন আনতে পানতা ফুরানো সংসারে প্রতিবন্ধী ছেলের মোবাইলের বায়না। এরপর মোবাইল কিনে দিলেন দরিদ্র পিতা ছেলেকে নিছক সময় পার করানোর জন্য। তবে মোবাইল দিয়ে কীভাবে যেন ১০০ টাকা আয় করে দিল। ওই দিনটা ছিল তাঁর ছেলের সবচেয়ে আনন্দের দিন। এরপর অনেক জোরাজুরির পর সুদে টাকা নিয়ে একটা কম্পিউটার ক্রয় করে দেন ছেলেকে। সেই যে শুরু এরপর থেকে আর থামেনি গোলাম রাব্বানী।’ গোলাম রাব্বানীর পিতা মো. বাবুল খান বলেন, ‘আমার ছেলে পড়াশোনা করেনি। সম্পূর্ণ অচল, কিন্তু এখন আয় করছে। এটা ভেবে আমি গর্বিত। তবে কাজের পরিবেশ নিয়ে আমি সব সময় উদ্বিগ্ন থাকি।’ মুসুল্লিয়াবাদ ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রভাষক মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘সঠিক সাপোর্ট পেলে এরা কখনো পরিবার ও সমাজের বোঝা হয় না। যার প্রমাণ গোলাম রাব্বানী।’