দেশে এখন ভয়াবহ মামলাজট। বিচারাধীন মামলা বৃদ্ধির গতি যেন কমানোই যাচ্ছে না। চলতি বছর প্রথম তিন মাসেই জটের খাতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ৫৫ হাজার মামলা। সব মিলিয়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ১৬৮টি। গত বছর শেষে এ সংখ্যা ছিল ৪৫ লাখ ১৭ হাজার ২০১। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা নিষ্পত্তির তুলনায় দায়েরের সংখ্যা বেশি হওয়ায় জট বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা কম থাকায় নিষ্পত্তিও বাড়ছে না। তাই এখনই মহাপরিকল্পনা করে পাহাড়সম এ মামলার জট নিরসন করতে হবে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে মামলাজট নিরসনে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এসব সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে জট কমতে পারে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সুপ্রিম কোর্টের বিবরণী শাখার চলতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে দেশে নতুন করে মামলা দায়ের হয়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৮৬০টি। একই সময়ে প্রাপ্ত ও পুনর্জীবিত মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৮২টি। অন্যদিকে প্রথম তিন মাসে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ৩ লাখ ২৩ হাজার ৭৯৮টি। একই সময়ে বদলি করা হয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৯৮১টি মামলা। ত্রৈমাসিক এ হিসাবে জটের খাতায় নতুন করে যুক্ত হয় ৫৩ হাজার ৯৬৭টি মামলা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট বিচারাধীন ৪৫ লাখ ৭১ হাজার ১৬৮ মামলার মধ্যে অধস্তন আদালতের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৩৯ লাখ ৩৭ হাজার ৬১টি। অন্যদিকে আপিল বিভাগে ৩৪ হাজার ৯৮১ এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৯৯ হাজার ১২৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অথচ গত বছর শেষে অধস্তন আদালতে ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২, আপিল বিভাগে ৩১ হাজার ১২০টি এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১টি মামলা বিচারাধীন ছিল। অর্থাৎ চলতি বছর প্রথম তিন মাসে অধস্তন আদালতে ৪১ হাজার ২২৯, আপিল বিভাগে ৩ হাজার ৮৬১ এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৯ হাজার ৪৭৫টি মামলা নতুন করে জটের খাতায় যুক্ত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর শেষে দেশে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪৫ লাখ ১৬ হাজার ৬০৩টি। এর মধ্যে অধস্তন আদালতের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ধরনের ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৩৮ লাখ ৯৫ হাজার ৮৩২টি। এখানে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ দেওয়ানি ও ফৌজদারি ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৫টি। অন্যদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ১২০টি। যার মধ্যে দেওয়ানি ১৯ হাজার ২৯১, ফৌজদারি ১১ হাজার ৬১৯ ও অন্য ২১০টি। একই সময় পর্যন্ত হাই কোর্ট বিভাগে বিচারাধীন মামলা ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৬৫১টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ৯৮ হাজার ৬১৯ ও ফৌজদারি ৩ লাখ ৫৪ হাজার ৯৮১, রিট ১ লাখ ১৫ হাজার ২১২ এবং আদিম মামলা (অন্যান্য) ২০ হাজার ৮৩৯টি।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মো. মোয়াজ্জেম হোছাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি ইতোমধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। রোডম্যাপ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে মামলাজট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে।’
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য, সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, ‘মামলাজটের অন্যতম কারণ মামলা দায়ের অনেক বেশি হচ্ছে। ছোট ছোট বিষয়েও মামলা হয়।’ তিনি বলেন, ‘আবার বিচারকসংখ্যা কম থাকায় মামলা নিষ্পত্তিও বাড়ছে না। ফলে জট বাড়ছে।’
সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, ‘মামলাজট নিরসনে আমরা বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছি কমিশনের প্রতিবেদনে। এর মধ্যে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আমরা অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছি। এটা করতে পারলে খুব দ্রুত অনেক বিচারাধীন মামলা কমানো যাবে। একই সঙ্গে আরও অধিকসংখ্যক বিচারক নিয়োগের সুপারিশও করা হয়েছে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।’ জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকার ও বিচার বিভাগের উদ্যোগের ফলে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছিল। তবে সে সময়ও নিষ্পত্তির হার দায়েরের তুলনায় কম ছিল। ২০১৬ সালে মামলাজট অপেক্ষাকৃত কমতে শুরু করে। ২০২২ সালে প্রথম ও সর্বশেষ মামলা দায়ের অপেক্ষা নিষ্পত্তি বেশি হয়। এরপর মামলাজট বাড়ার লাগাম টানা গিয়েছিল। কিন্তু গত বছরের শেষ ছয় মাসে বিচার বিভাগে কার্যত অচলাবস্থা দেখা দেয়। গত বছর প্রথম ছয় মাসে ৮১ হাজার ৩৬৩টি মামলা জটের খাতায় যুক্ত হলেও শেষ ছয় মাসে বেড়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সারা দেশে সরকারি আইন কর্মকর্তা পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে অধস্তন আদালতে ব্যাপক হারে রদবদল করা হয়েছে। হাই কোর্টে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ২৩ জন অতিরিক্ত বিচারপতি। বিচার বিভাগের সংস্কারে গঠন করা হয়েছিল কমিশনও। গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের দেওয়া ৩৫২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে মামলাজট কমানোসহ ৩২ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে গঠন করা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে মামলাজট নিরসনের বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। অধস্তন আদালতের বিচারকসংখ্যা অন্তত ৬ হাজারে উন্নীত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে সুপারিশে। অন্য সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও বিচারক নিয়োগে কমিশন গঠন; অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, বিচার বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ, বিচার বিভাগকে যথাসম্ভব নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। বিচার বিভাগের যথাযথ বিকেন্দ্রীকরণ এবং মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এসব সুপারিশের মধ্যে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশসহ বেশ কিছু সুপারিশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। আইন সংশোধনসংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়নেও কাজ চলছে বলে জানা গেছে।