সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই অনভিপ্রেত বিতর্ককে কেন্দ্র করে পতিত ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ মিলিতভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জনগণের দূরত্ব বাড়িয়ে দেশে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টিরও অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ভারত বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এখন ষড়যন্ত্র ঘরে-বাইরে, লক্ষ্য সশস্ত্র বাহিনী। অবিলম্বে সশস্ত্র বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রয়োজন।
গতকাল রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) হেলমেট হলে আয়োজিত ‘রাষ্ট্র সংস্কার : রাজনীতি প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র বাহিনী’ শীর্ষক সেমিনারে আলোচকরা এসব কথা বলেন। চার ঘণ্টারও বেশি সময়ের অনুষ্ঠানে রাওয়ার চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হকের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম বক্তব্য দেন। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ড. মাহমুদুর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. আবদুল্লাহ আল ইউসুফ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কর্নেল (অব.) মো. আহসান উল্লাহ। অনুষ্ঠানে সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়ায় ড. মাহমুদুর রহমান মূল প্রবন্ধে রাজনীতি প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যাশায় বিশদ আলোচনা তুলে ধরেন। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও সামরিক বাহিনীতে পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন, বাণিজ্যিক সম্পর্ক রহিতকরণ, বেসামরিক দায়িত্ব থেকে পৃথকীকরণ, স্বচ্ছ সামরিক বাজেট এবং প্রশিক্ষণে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের ব্যাপারে জোর দেন। পাশাপাশি জনগণ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভারতীয় আধিপত্যবাদী আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে সব সময় সতর্ক হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব কর্তৃক সেনাবাহিনীকে ব্যবহার প্রতিরোধের ওপর জোর দেন, যেখানে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত সামরিক অফিসারদের বিচার এবং সর্বোপরি প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আল ইউসুফ সশস্ত্র বাহিনীকে দলীয় অপরাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রয়োজন এবং একইভাবে রাষ্ট্রীয় সামরিক এবং অসামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণও কোনো একক ব্যক্তি কিংবা পদের অধীনে থাকাটা নিরাপদ নয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র তথা জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শুধুই একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা নীতি কিংবা একজন দক্ষ প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা যথেষ্ট নয়, বরং আমাদের প্রয়োজন একটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তা নীতি, একটি কার্যকর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, সংশ্লিষ্ট সংস্থাপনা বা সচিবালয় এবং একজন দক্ষ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা যিনি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরামর্শ দেবেন। এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন গঠনের ব্যাপারে তিনি মত দেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বীরবিক্রম বলেন, সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে। ১৯৭১ সালের পর ভারত আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে বিরোধ তৈরি করেছে। আমাদের মধ্যে একতা ধরে রাখতে হবে। এটার খুব অভাব। আমাদের মূল দায়িত্ব হবে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা। তিনি বলেন, বুঝতে হবে- ভারত বাংলাদেশের কখনই ভালো চায় না। তারা বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। প্রশিক্ষণের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর কাউকে যেন ভারতে পাঠানো না হয়। এতে অনেকে অনৈতিক বিষয়ে জড়িয়ে পড়েন। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এইচ এম এরশাদ। তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, বিডিআর বিদ্রোহে ভারতের ব্ল্যাক ক্যাট জড়িত ছিল। তারা শেখ হাসিনার পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তিনি বলেন, কোনো অবস্থায়ই সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া সশস্ত্র বাহিনীর উচিত হবে না। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুল হক বলেন, ফ্যাসিবাদরা আবার জাগ্রত হচ্ছে। ষড়যন্ত্র ঘরে-বাইরে। লক্ষ্য বা টার্গেট হলো সশস্ত্র বাহিনী ও ইসলামি মূল্যবোধ, যে ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত এদেশীয় দালালরা। মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন পদবির সশস্ত্র বাহিনীর অফিসাররা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সশস্ত্র বহিনীর প্রত্যাশা করেন। তারা সশস্ত্র বাহিনীর সংস্কারকল্পে যুগোপযোগী এবং যুগান্তকারী নীতিমালা প্রণয়নের ব্যাপারে জোর দেন।