গাজীপুরে একের পর এক সরকারি বন বিভাগের জমি দখল করে যমুনা গ্রুপ বিভিন্ন কারখানা স্থাপন করলেও প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল গাজীপুরের যেদিকে নজর দেন, সেদিকে সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানা কোনো সম্পত্তিই তার হাত থেকে রেহাই পায় না। যে কোনো উপায়ে ওই জমি বাবুল তার দখলে নেন। তাই গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন যমুনা গ্রুপ বা বাবুলকে আতঙ্ক হিসেবেই দেখে থাকে।
যমুনার বাবুলের বদনজর থেকে রেহাই পায়নি কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর এলাকার কানারটেক নামে পরিচিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের আশ্রয় নেওয়া সরকারি একটি জায়গাও। রাতের অাঁধারে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সহায়তায় বাবুল ওই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী লোকজনকে উচ্ছেদ করে নিজের দখলে নিয়ে নেন পুরো জমি। যমুনার বদনজর থেকে রেহাই পায়নি হিন্দু, মুসলমান, অসহায়, গরিব মানুষ কেউই। তাদের এসব কর্মকাণ্ডের কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর নেমে আসে অমানবিক নির্যাতন ও মামলা-মোকদ্দমার হয়রানি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষে সফিপুর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সফিপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু পূর্বে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের দক্ষিণে সরকারি বন বিভাগের সোয়া তিন একর সম্পত্তি ১৫ বছর আগে স্থানীয় এক প্রভাবশালী ইউপি সদস্যের সহায়তায় রাতারাতি দখল করে নিয়েছেন যমুনার বাবুল। এ এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণদের বসতি ছিল বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়। দখলকৃত জমির একটি টেকে কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্ধদের (দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী) ৬০টি পরিবার এনে আশ্রয় দেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। কিন্তু যমুনার বাবুলের থাবা থেকে এখানেও রেহাই পাননি এই অসহায় অন্ধরা। তাদের দিনে-দুপুরে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে উচ্ছেদ করা হয়। পরে দখলকৃত ভূমিতে যমুনা গ্রুপ হান্টার নামের একটি মদের কারখানা স্থাপন করে।
এলাকাবাসী অভিযোগ করে বলেন, বদর আমিন নামের এক জমির দালাল সরকারি এসব সম্পত্তির ভুয়া কাগজ তৈরিতে সহযোগিতা করেন। জমির মালিক হরিচরণ রায় জানান, 'আমার বাবা রায়চরণের নামে সিএস এবং এসএ পর্চায় দাগ খতিয়ান থাকলেও ভুয়া দলিল তৈরি করে যমুনা গ্রুপ আমাদের বাপ-দাদার বসতভিটা দখল করে নিয়েছে। আমরা এখন ভিটাছাড়া হয়ে অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকি।' সফিপুরে দখলকৃত যমুনা গ্রুপের ছবি তুলতে গেলে সিকিউরিটি গার্ডরা হুমকি-ধমকি দেয়। একপর্যায়ে সিকিউরিটিরা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে ক্যামেরা, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে আশপাশের দোকানিদের সহায়তায় তিনি রক্ষা পান। কারখানায় কর্মরত এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যমুনার সাতটি কারখানায় সরবরাহকৃত গ্যাস সংযোগ দুটি লাইনে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি লাইন বৈধ হলেও অন্যটি অবৈধ। অবৈধ লাইনের জন্য মাসে মাসে মাসহারা নেয় তিতাস কর্তৃপক্ষ। যমুনার দখলকৃত ভূমিতে গড়ে ওঠে সাতটি কারখানা। এসব কারখানার বর্জ্য পাইপ দিয়ে সড়কের উত্তরে গাজীপুরের বিখ্যাত মশক বিলে অপসারণ করা হচ্ছে। এতে মশক বিল পরিণত হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতায়। কথিত আছে, মশক বিলের জমিতে এক সনে যা ধান হয়, তা দিয়ে অনায়াসে বছরের খোরাক চলে পুরো ভাওয়াল পরগনার। শুধু মশক বিল নয়, পাশের আন্ধারমানিক, নিশ্চিন্তপুর, সফিপুর পূর্বপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ চরমে। অন্যদিকে সড়কের উত্তরে ওয়ামি বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার হ্যাম্পটন ব্রিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজ অবস্থিত। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। যমুনার বর্জ্যের কারণে সেখানকার শিক্ষার্থীরা চরম অস্বস্তিকর পরিবেশে সময় পার করছে। আর পরিবেশ নষ্ট করার প্রতিবাদ করলে যমুনার বাবুল ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জায়গা দখল করার চেষ্টা করে। একসময় বাবুল ওই প্রতিষ্ঠানের জায়গাটুকু বেদখল করে ছোট ভাই সোহরাব উদ্দিনের নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়। প্রতিষ্ঠানটি আদালতে মামলা করলে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা উচ্ছেদ করে দেয়।
হ্যাম্পটন ব্রিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের নির্বাহী পরিচালক আহসান হাবিব জানান, যমুনার পরিবেশদূষণের ফলে কোমলমতি শিশুরা নানা ধরনের চর্মরোগে ভুগছে। যমুনার বর্জ্যের দুর্গন্ধে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে। মৌচাক বিট অফিসের কর্মকর্তা বজলুর রহমান সত্যতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, যমুনা গ্রুপ সফিপুর এলাকার সরকারি বনভূমির জায়গা দখল করে কারখানা গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, 'যমুনা বনভূমির সফিপুর এলাকার ৩৭১ দাগ নম্বরের ১ একর ৩৭ শতাংশ জায়গা দখল করার চেষ্টা করলে আমরা আদালতে মামলা করি। মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।' অন্যদিকে কালিয়াকৈরের সিনাবহ গ্রামের বন বিভাগ ও হিন্দুদের প্রায় ১০ একর সম্পত্তি স্থানীয় এক প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতাকে দিয়ে দখল করে নিয়েছে যমুনা। পরে ওই সম্পত্তিতে যমুনা ইলেকট্রনিকস নামের একটি কারখানা স্থাপন করে তারা। এ ঘটনায় স্থানীয় হিন্দুরা প্রতিবাদ করলে থানা পুলিশ দিয়ে জমির মালিকদের হয়রানি করা হয়। জমির মালিক নারায়ণ চন্দ্র বলেন, 'আমাদের জোতজমি জোর করে দখলে নিয়েছে যমুনা গ্রুপ। আমরা প্রতিবাদ করলে প্রথমে আমাদের বাড়ির খড়ের গাদায় আগুন দিয়ে আমাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করানো হয়। জামিন পাওয়ার পর আবার আমাদের বসতবাড়ির একটি ঘরে আগুন দিয়ে আমাকে আসামি বানিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। এভাবে জমির মালিকদের একের পর এক মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে জমি থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করছে বাবুল।'
আরেক জমির মালিক সঞ্জীবন কুমার বলেন, 'যমুনার বাবুল যেদিকে তাকান, সেদিক আর আমাদের থাকে না। হয়ে যায় বাবুলের জমি।' বন বিভাগের মৌচাক বিট অফিসের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যমুনার বিরুদ্ধে মামলা দিলেও কিছুই হয় না। আদালতের মাধ্যমে দখলকৃত জমিতে ১৪৪ ধারা জারি করিয়ে তারা কারখানা স্থাপন করে ফেলে। আমরা তো আইনের বেড়াজালে আটকে থাকি, যার জন্য তাৎক্ষণিক কিছুই করতে পারি না।' কালিয়াকৈর উপজেলার বন বিভাগের চন্দ্রা রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, 'এ এলাকায় অনেক সরকারি বনভূমি রয়েছে। এর মধ্যে অনেক কারখানার মালিক বিভিন্ন উপায়ে এসব জমি দখল করে নিয়েছে। দখলকৃতদের মধ্যে অন্যতম যমুনা গ্রুপ। আমরা যমুনার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করেছি। সফিপুরের একটি জায়গার মামলা ৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে।' কালিয়াকৈর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিনাত জাহান ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, যমুনাসহ অনেক কারখানার মালিকরা কালিয়াকৈরের বিভিন্ন সরকারি জমি বেদখল করে রেখেছেন। কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুর রহমান ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বড় বড় কারখানার মালিকরা সরকারি জমির পাশে কিছু পরিমাণ জমি কিনে প্রথমে কাজ শুরু করেন। পরে সরকারি জমি দখলে নেন।