মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ফাঁকি দিতে অভিনবপন্থা অবলম্বন করছে এনার্জি ড্রিংকস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এএসটি বেভারেজ লিমিটেড। 'রয়্যল টাইগার এনার্জি ড্রিংকস' ও 'ব্লাক হর্স' পণ্য দু'টিকে কার্বনেটেড বেভারেজ (কোমলপানীয়) ঘোষণা দিয়ে তা বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। অথচ এই দুই পানীয় কোমলপানীয়ের মধ্যেই পড়ে না!
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপনের (নম্বর-১৭১-আইন/২০১৩/৬৭৫-মূসক) মাধ্যমে কোমলপানীয়ের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ও এনার্জি ড্রিংকসের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ধার্য করে দিয়েছে।
এএসটি বেভারেজ ২০১১-১২ অর্থবছরে রয়্যাল টাইগার এনার্জি ড্রিংকস ও ব্লাক হর্স পণ্য দুটিকে কোমলপানীয় হিসেবে বিবেচনা করে ১৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক দেয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি কর দেয় ৩৭ কোটি টাকা। কিন্তু পণ্যের মাননিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের সংজ্ঞা অনুযায়ী, পণ্য দু'টি কোমল পানীয়ের মধ্যে পড়ে না।
বিসিএসআইআর-এর টেস্টিং রিপোর্ট অনুযায়ী এ দুটিতে পানীয়ের মূল উপাদান সোডিয়াম ব্যানজয়েট ও ক্যাফেইন বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানের চেয়ে আশঙ্কাজনক হারে বেশি পাওয়া গেছে।
রয়্যাল টাইগার এনার্জি ড্রিংকসে ক্যাফেইন ও সোডিয়াম ব্যানজয়েটের পরিমাণ যথাক্রমে লিটার প্রতি ২৭৬ মিলিগ্রাম এবং ১৭০ মিলিগ্রাম। কিন্তু বিএসটিআই-এর অনুমোদনপ্রাপ্ত কার্বনেটেড বেভারেজের সংজ্ঞায় এ দু'টি রায়াসনিকের মাত্রা যথাক্রমে প্রতি লিটারে ১৪৫ মিলিগ্রাম এবং ১৬০ মিলিগ্রামের নিচে হওয়ার কথা।
এছাড়া আরো বেশি রাসায়নিক ব্লাক হর্সে মেশানো হয়। এতে প্রতি লিটারে ক্যাফেইন মেশানো হয় ১৭৭ মিলিগ্রাম এবং ২৪৪ মিলিগ্রাম সোডিয়াম ব্যানজয়েট। অর্থাৎ সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী রয়্যাল টাইগার এনার্জি ড্রিংকস ও ব্লাক হর্স কোমলপানীয়ের মধ্যে পড়ে না। মূলত কর ফাঁকির উদ্দেশ্যেই এনার্জি ড্রিংকসকে কোমলপানীয় হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্যাফেইন একটি উত্তেজক রাসায়নিক। যা মানবদেহে প্রতি লিটারে ১৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য। এ মাত্রা অতিক্রম করলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া ক্যাফেইন মাদকশ্রেণীভুক্ত ১১টি উপাদানের অন্যতম।
এ প্রসঙ্গে বিএসটিআই-এর সহকারী পরিচালক গোলাম বাকি বলেন, যেসব কোমল পানীয়তে অ্যালকোহল ও উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন থাকে সেগুলো কার্বনেটেড বেভারেজ নয়। এগুলোকে এনার্জি ড্রিংকস বা অন্য কিছু বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, কার্বনেটেড বেভারেজের ক্ষেত্রে বিএসটিআই-এর নির্ধারিত মান বা বিডিএস রয়েছে। কিন্তু এনার্জি ড্রিংকের কোনো বিডিএস বা নির্ধারিত মান নেই।
গোলাম বাকি জানান, কার্বনেটেড বেভারেজের সংজ্ঞায় ক্যাফেইন ও সোডিয়াম ব্যানজয়েটের পরিমাণ যথাক্রমে প্রতি লিটারে ১৪৫ মিলিগ্রাম ও ১৬০ মিলিগ্রাম নিচে হবে। এর বেশি হলে তা কোমলপানীয়ের আওতায় পড়বে না।
যোগাযোগ করা হলে আইইডিসিআর-এর জ্যৈষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. মনির বলেন, সোডিয়াম বেনজয়েট উচ্চমাত্রায় গ্রহণ করলে মানুষের পরিপাকতন্ত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কিডনি অকেজো হওয়া ও আলসার হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে গর্ভপাত বা অটিস্টিক শিশু জন্মের আশঙ্কা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
আইইডিসিআর-এর এই বৈজ্ঞানিক বলেন, সোডিয়াম ব্যানজয়েট এক ধরনের প্রিজারভেটিভ যা মানবদেহে খাদ্য হজমে সহায়তাকারী উপকারী ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করে দেয়। ফলে হজমের সমস্যা হয়। এক পর্যায়ে আক্রান্ত হয় কিডনি ও লিভার। তিনি আরও বলেন, এনার্জি ড্রিংক নিয়মিত খাওয়ার ফলে একজন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ) সূত্রে জানা যায়, মূল্য সংযোজন কর আইন/বিধিমালা/প্রজ্ঞাপন/সাধারণ আদেশ দ্বারা কোমলপানীয় ও এনার্জি ড্রিংকসকে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণও দেওয়া নেই।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এএসটি বেভারেজে পানীয় দু’টি এনার্জি ড্রিংকস হওয়া সত্ত্বেও কোমলপানীয়ের কর দিয়ে আসছে। উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক নির্ধারণ করে মূল্য ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
সূত্র জানায়, বাজারের অন্যান্য পানীয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এএসটি বেভারেজ রয়্যাল টাইগার এনার্জি ড্রিংকস ও ব্লাক হর্স বাজারে আনে।
এরমধ্যে থাকা রাসায়নিক উপাদানে মাদকাসক্তি তরুণ সমাজে অল্পদিনেই জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু কোম্পানির অন্যান্য পানীয় বাজারে বিক্রি হয় না বললেই চলে।
বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা বলেন, জনস্বার্থে ক্ষতিকর পণ্যের বৈধতা-অবৈধতা দেওয়ার ক্ষমতা দপ্তরের নেই। এ বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব বিএসটিআই ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এসব জায়গা থেকে
পণ্য বাজারজাতকরণের অনুমতি দিলে আমরা শুধু পণ্যের মূল্য ঘোষণার অনুমোদন দেই। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি যথাযথভাবে কর দিয়ে যাচ্ছে কি-না তা মনিটরিং করা হয় বলেও তিনি জানান।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, এই দুই পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন ও সোডিয়াম ব্যানজয়েট মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সূত্র: বাংলানিউজ