সংবিধান সংশোধন, বিচারপতিদের অভিশংসন ও তার প্রেক্ষাপট নিয়ে এখনই তাড়াহুড়ো নয় বলে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আজ সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ মতামত দেন।
আলোচনায় এ বিষয়ে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন- সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
সংবিধান প্রণেতা ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, 'বিচার বিভাগের ওপর আঘাত করা মানে আমাদের সংবিধানের উপর আঘাত করা। ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্রের বয়স ৬০/৭০ বছর হয়েছে। আমাদেরও ৪২ বছর পার হয়েছে। আমেরিকার ২০০ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাস আছে। আমরা জানি ৪২ বছরের ভালোমন্দ কী অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি! ভারতের ৭০ বছরের অর্জন আমরা জানি। আমেরিকার ইতিহাসও আমাদের সামনে আনতে হবে।'
ড. কামাল বলেন, 'ষোড়শ সংশোধনী যেভাবে তড়িঘড়ি করে করা হচ্ছে, এইভাবে কোনো সংশোধনী মোটেই জনস্বার্থের পক্ষে না।'
তিনি বলেন, 'সংবিধানের এই ধরনের সংশোধনীর ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে জনমত যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। শুধু বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষেত্রেই না, অন্যান্য সব ক্ষেত্রেও আমাদের ব্যাপক জনমত যাচাই করা দরকার।'
তিনি আরো বলেন, 'বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য নিয়োগ পদ্ধতির থাকা দরকার ছিল। সরকার সেটা না করে বিচারকদের সরানোর জন্য কেন আইন করছে, সেটা আমাদের অবশ্যই ভেবে দেখতে হবে।'
প্রবীণ এই সংবিধান প্রণেতা বলেন, 'বিচারপতিদের অভিশংসনের এই ধারার এ সংশোধনীর ক্ষেত্রে অবশ্যই জাতীয় সংলাপ প্রয়োজন। সেটা শুধু রাজধানীতেই নয়, জেলায় জেলায় সংলাপের মাধ্যম্যে জনমত যাচাই করতে হবে। আসলেই জনগণ এই সংশোধন চায় কিনা সেটা দেখতে হবে।'
তিনি বলেন, মন্ত্রিসভা বলে দিলো আর আমরা কালই সেটার আইন পাস করে দিলাম! আমরা এই ধরনের চারদিনের সংবিধান সংশোধন চাই না।
ড. কামাল বলেন, 'সংসদ কী কার্যকর হচ্ছে, নাকি দলীয়ভাবে কাজ করছে? বিবেকের ভিত্তিতে সত্যের পক্ষে কথা বলছে কিনা সেটা আমাদের দেখতে হবে। যে সব দেশে অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের ওপর আছে, সেখানে দলীয়ভাবে বিবেচনা করা হয়না। সবকিছুই নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করা হয়। কোনো বিচারকের অন্য দলের প্রতি আনুগত্য আছে বলে তাকে আমরা ঘায়েল করবো, এটা করা ঠিক হবে না।'
কলামিস্ট আবুল মকসুদ বলেন, '৭২-এর সংবিধানে যাওয়ার কথা আমরা আগেও শুনেছি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে যেহেতু বিতর্ক উঠেছে, উদ্বিগ্ন দেখা দিয়েছে, তাই এর বিহীত হওয়া দরকার।'
তিনি বলেন, 'এ ক্ষেত্রে সাবেক প্রধান বিচারপতিরা রয়েছেন, প্রবীন আইনজ্ঞ ও আইনজীবীরা রয়েছেন। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সাধারণ সম্পাদকেরা রয়েছেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেলরা রয়েছেন। সবাইকে নিয়ে বসে এর বিহীত করতে হবে। এতে সরকারেরও অস্থির হওয়ার কিছু নেই, আমাদেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।'
সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ করা হচ্ছে।' মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় তিনি এ সব কথা বলেন।
তিনি বলেন, 'এই সংশোধনীর মাধ্যমে শুধু বিচারকদের অপসারণের বিধান হচ্ছে না, এর মাধ্যমে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অপসারণের ক্ষেত্রেও উচ্চ আদলতের বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিই প্রযোজ্য।'
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, 'সংবিধানের ১১৮(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের বিচারক যেরূপ পদ্ধতি ও কারণে অপসারিত হতে পারে, সেইরূপ পদ্ধতি ও কারণে কোনো নির্বাচন কমিশনারও অপসারিত হবে। এমনিভাবে মহাহিসাব নিরীক্ষক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও অন্য সদস্যদের অপসারণের ক্ষেত্রে যথাক্রমে সংবিধানের ১২৯(২) ও ১৩৯(২) অনুচ্ছেদের বিধানও একই।'
বৈঠকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, 'আমাদের উদ্বেগের বিষয় হলো ষোড়শ সংশোধনীতে শুধু বিচারকদের অভিসংশন কেন, অন্য কোনো বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন?'
তিনি বলেন, 'যদি এই সংশোধনী হয়ে যায়, তবে আওয়ামী লীগের আমলে যে সব বিচারকেরা নিয়োগ পাবেন, বিএনপি কখনো ক্ষমতা পেলে পালাক্রমে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এই সব বিচারকদের গণহারে অভিসংশন করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকার একটি উদাহরণ দেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে সংসদের হাতে আছে, সেভাবে আমাদের হাতে থাকবে। আমি বলবো, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কি আমাদের মতো গৃহপালিত বিরোধী দল আছে? এত সবকিছু বাদ দিয়ে যদি শুধু একটি মিলের দিকে তাকিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়, তবে দেশ শ্রীলঙ্কার মতে হয়ে যাবে। ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠার যে ব্যাপক প্রচারণা দেখতে পাচ্ছি, এটা কার্যকর হবে।'
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান বলেন, 'অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়ার আগে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং তাদের ইনকোয়ারির ক্ষমতা দিতে হবে, যাতে তাদের তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলে সংসদ ব্যবস্থা নিতে পারে, তার আগে নয়।'
গোলটেবিল আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগ্রেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান, সুজনের চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ, বিশিষ্ট সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান প্রমুখ।