আজ ২৬ মার্চ। বাঙালির শৃঙ্খলমুক্তির দিন। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বিশ্বের বুকে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানোর দিন আজ।
হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্বের বুকে স্বাধীনতার অস্তিত্ব ঘোষণা করেছিল বীর বাঙালি। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হিসেবে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল এ ব-দ্বীপের মানুষ। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সূচনার সেই গৌরব ও অহংকারের দিন আজ। আজ থেকে ঠিক ৪৫ বছর আগের ঠিক এমনই এক ভোররাতে পাকিস্তানি হিংস্র শ্বাপদের গণহত্যার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করার শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনপণ সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বীর বাঙালি। ঘোরতর ওই অমানিশা ভেদ করেই দেশের আকাশে উদিত হয় স্বাধীনতার চিরভাস্বর সূর্য। বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই শুরু হয়েছিল একাত্তরের আজকের এই দিনে। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম অর্জন—মহান স্বাধীনতা। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার প্রতি জানায় অকুণ্ঠ সমর্থন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার আড়ালে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। আসে একাত্তরের আগুনঝরা মার্চ। দলমত নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু করে অসহযোগ আন্দোলন। সে আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধিকার সংগ্রামে। জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে নিজ কণ্ঠে ধারণ করে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মুজিব রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ডাক দেন স্বাধীনতার। শোনান মুক্তির মহাকাব্য, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার ৭ মার্চের ভাষণ ছিল স্বাধীনতার সমার্থক। সেই ডাকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। বাঙালি জাতিসত্তাকে নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের মাধ্যমে শুরু করে ভয়াবহ গণহত্যা, যার নাম অপারেশন সার্চলাইট। মধ্যরাতেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বরের বাড়ি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ভবন) থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইপিআরের ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ডাক দেন। ইংরেজিতে দেওয়া সেই স্বাধীনতা ঘোষণার বাংলা অনুবাদ হলো, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা—আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ একই সঙ্গে তিনি বাংলায় যে বার্তা পাঠান সেটি হলো—‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রু বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’ শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী। বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। আজ স্বাধীনতার ৪৬ বছরে পা দিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকে আমাদের সব আশা পূর্ণ হয়নি সত্যি তবে অর্জন রয়েছে অনেক। অর্থনীতি গতিশীল হয়েছে। দারিদ্র্য কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। কমেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। দেশ এগিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। স্বাবলম্বী হয়েছে নারী। বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু, সেই সঙ্গে জাতীয় আয়। স্বাস্থ্যসেবা বাড়ায় কমেছে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হার। অনুন্নয়নের কাঁচা রাস্তা ছেড়ে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে আজ মধ্য আয়ের দেশের সারিতে দাঁড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সাড়ে চার দশকের পথচলায় কিছু নেতিবাচক, কিছু ব্যর্থতা আছে। সেসব বাদ দিলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৪৬ বছর আগে যারা বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছিলেন তাদের সিংহভাগই ছিলেন তরুণ। আজকের বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই তরুণ প্রজন্মের ওপর। তরুণরাই পারে স্বাধীনতার শহীদদের ঋণ শোধ করতে।
যাদের রক্ত ও সম্ভ্রমের মূল্যে আমরা পেয়েছি মহামূল্যবান এই স্বাধীনতা, তাদের কাছে মহামূল্য ঋণ। গভীর কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে তাদের স্মরণ করার দিন আজ। মহান স্বাধীনতা দিবসে জাতি আজ উৎসবের পাশাপাশি গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর বেদনায় স্মরণ করবে মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদকে। স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী তার সহকর্মী জাতীয় নেতাদের। জাতি শ্রদ্ধা জানাবে বীরাঙ্গনা আর শহীদমাতাদের। দৃপ্ত শপথ নেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করার; স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এবং বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার। আজ প্রত্যুষে রাজধানীতে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে মহান এ দিবসটি পালন করা হবে। সব ভবনে ও শহরের প্রধান সড়কগুলোতে উড়বে রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা। সকালে ফুলে ফুলে ভরে উঠবে জাতীয় স্মৃতিসৌধ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে দলমত নির্বিশেষে সেখানে হাজির হবে লাখো মানুষ। প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পুষ্পস্তবক অর্পণের পরই সাধারণের জন্য স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এরপর সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সুসজ্জিত একটি দল গার্ড অব অনার প্রদান করবে। সকালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শিশু-কিশোর সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রমসহ এ ধরনের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও পালিত হবে স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পৃথক বাণীতে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও বীরত্বগাথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ এবং শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন। এ ছাড়া দিবসটি উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্রে বিশেষ নিবন্ধ ও অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হচ্ছে। যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে জাতীয়ভাবেও ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, সকাল ৭টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদলের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের মাজারে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন এবং আগামীকাল রবিবার কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা, এতে সভাপতির বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বিএনপিও দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, গণফোরাম, বাসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নসহ অসংখ্য সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
বিডি-প্রতিদিন/২৬ মার্চ, ২০১৬/মাহবুব