সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীকে কোণঠাসা করে রেখেই প্রহসনমূলক তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের বিজয় নিশ্চিত করেছিল। নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা পুলিশ কর্মকর্তাদের মতোই নির্বাচনী অপরাধের জন্য কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন—এই বিধান সে সময় ক্ষমতাসীনরা মেনে নিতে পারেনি। সশস্ত্র বাহিনীর ওই ক্ষমতাকে তারা তাদের ভোট লুটের অন্তরায় মনে করে এবং ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলোকে (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী) বাদ দেওয়া হয়। এর ফলে নির্বাচনী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে একজন আনসার সদস্যের যে ক্ষমতা ছিল সেনা সদস্যদের তা ছিল না।
স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেও সেনাবাহিনীকে একইভাবে ক্ষমতাহীন করে রাখা হয়। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনগুলোতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালা ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সেনাবাহিনী মোতায়েনেও গড়িমসি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের। এই পর্যবেক্ষণ নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ‘২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন সেনাবাহিনী নিয়োগের জন্য সরকারকে চিঠি দেয়।
কিন্তু সেনা নিয়োগ তো দূরের কথা সরকার সেই চিঠির জবাব পর্যন্ত দেয়নি।’ এ ছাড়া ২০১৫ সালের তিন সিটির নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন চার দিনের জন্য সেনা নিয়োগের ঘোষণা দিলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। পরে জানানো হয়, সেনাবাহিনীকে সেনানিবাসেই রিজার্ভ অবস্থায় রাখা হয়েছে। তবে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা সংস্থার সংজ্ঞায় আবারও ফিরে আসছে সশস্ত্র বাহিনী।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তেমনটাই সুপারিশ করেছে এবং নির্বাচন কমিশনও এ জন্য আরপিও সংশোধনের জন্য মন্ত্রিপরিষদে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
এ ছাড়া বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে সেনাবাহিনীর যে অবস্থান তাতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনীকেই প্রধান ভরসার স্থল হিসেবে দেখা হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল (স্টাফ কর্নেল) মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। তবে নির্দেশনা পেলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য বেগম জেসমিন টুলি বলেন, ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আরপিওর ৮৭ অনুচ্ছেদে এই বিধান যুক্ত করা হয় যে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা-ই থাকুক না কেন, নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্ব পালনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা না হয়েও নির্বাচনী অপরাধের জন্য কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন। ২০০১ সালে এই বিধান অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিওতে যুক্ত করা হয়। শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনগুলোতেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তুর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগ বাদ দেয়। এর ফলে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, আনসার, বিজিবি, কোস্ট গার্ডের যে ক্ষমতা তা সশস্ত্র বাহিনীর থাকে না। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ ভোটাররাও মনে করে, সে সময় ‘যেমন ইচ্ছা তেমন নির্বাচন’ কৌশল বাস্তবায়নের জন্যই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে কার্যকর ভূমিকায় রাখতে চায়নি। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থা কমিশন মনে করে, নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে কার্যকর ভূমিকায় রাখলে দেশের বর্তমান বেহাল অবস্থায় একটি ভালো নির্বাচন সম্ভব।
ড. মো. আবদুল আলীম বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। আজ যে ছবিসহ ভোটার তালিকা, এনআইডি এগুলো সশস্ত্র বাহিনীরই অবদান। সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া এই বিশাল কাজ করা সম্ভব ছিল না। দেশে যে কটি জাতীয় নির্বাচন অনেকাংশে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে সেগুলোতে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যকর সহযোগিতা ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তৎকালীন সরকার সেনাবাহিনীকে কার্যকরভাবে নির্বাচনী দায়িত্বে রাখতে চায়নি। কারণ সেনাবাহিনীর সদস্যরা নির্বাচনী এলাকায় দায়িত্ব পালনের সময় নির্বাচনী অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশের মতো কোনো দলের নেতাকর্মীদের চেনেন না। তাঁরা নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীনভাবে দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এই অবস্থান ভোট লুটের অন্তরায়।
যেভাবে দূরে রাখা হয়েছিল সেনাবাহিনীকে : সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তাদের অনেকেই তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলে আসছেন, গত ১৫-১৬ বছরে নির্বাচনের দায়িত্ব পালনে ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালা ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় সেনাবাহিনী মোতায়েনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে সেনাবাহিনীকে রাখলে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে না-ও হতে পারে। কারণ ম্যাজিস্ট্রেটরা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হতে পারেন, অথবা তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যা সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতাকে বিঘ্নিত করতে পারে। এর ফলে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা কমে যেতে পারে।
২০১৭ সালে কে এম নুরুল হুদা কমিশনের নির্বাচনী সংলাপে যোগ দিয়ে সাবেক কয়েকজন নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী ম্যাজিস্ট্রেটেরর অধীনে থাকলে তাদের দায়িত্ব পালন সঠিক হবে না। তবে তাঁদের এই মতামত আমলে নেওয়া হয়নি।
এর আগে ২০১১ সালে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় আবারও সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখে।
বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ওই সংলাপে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, এ প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়। পরবর্তী সময়ে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে ফের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি।
কাজী রকিবের নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রহসনমূলক দশম সংসদ নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। তবে নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার বা প্রিজাইডিং অফিসারের চাহিদা ছাড়া সেনাবাহিনীর ভোটকেন্দ্রের ভেতর কিংবা ভোট গণনা কক্ষে কোনো প্রকার দায়িত্ব গ্রহণ করা নিষিদ্ধ রাখা হয়। কাজী রকিবের কমিশন ২০১৫ সালে ঢাকার দুই সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়।
নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রথমে জানানো হয়, মহানগরীর ভেতর সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকবে। রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশ পাওয়ামাত্র তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেবে। সেনা সদস্যদের সঙ্গে ১৬ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবেন। কিন্তু পরে জানানো হয়, সেনাবাহিনী মূলত সেনানিবাসের অভ্যন্তরে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে অবস্থান করবে এবং রিটার্নিং অফিসারের অনুরোধে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে। কিন্তু ব্যাপক অনিয়মের ওই ভোটে রিটার্নিং অফিসাররা সে ধরনের কোনো অনুরোধ করেননি বা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়নি।
তার আগে ২০১১ সালের অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের তৎকালীন এ টি এম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দুই দিন আগে সেনা নিয়োগ চেয়ে সরকারের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে চিঠি দিয়েছিল। এ বিষয়ে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, নারায়ণগঞ্জে এমন কিছু হয়নি যে সেনা মোতায়েনের প্রয়োজন ছিল। ওই ঘটনায় সে সময় সংবিধান প্রদত্ত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিএনপির পক্ষে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন না করে প্রধানমন্ত্রী এবং নির্বাচন কমিশন উভয়ই সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। এ জন্য তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে৷ এতে প্রমাণিত হয়েছে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। আর নির্বাচন কমিশনও সরকারের আজ্ঞাবহ। এই অবস্থায় নির্বাচন কমিশন কেন সেনা মোতায়েন হলো না, এর জবাব চেয়ে সরকারের কাছে চিঠি লেখে। কিন্তু জবাব মেলেনি। সে সময় ওই নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে সরকারের নিষ্ক্রিয়তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনও হয়। রিট আবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ১২০, ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কমিশনকে সহায়তা করতে বাধ্য। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন সেনা মোতায়েন চেয়েছিল। তারপরও করা হয়নি।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ