যশোরের ঝিকরগাছার এক নারী পাচারকারী বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে দুই নারীকে ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে ভারতে নিয়ে যান। এই নারীদের ভারতের মহারাষ্ট্রের এক পতিতালয়ে রাখা হয়। পরে ভারতের একটি সেফ হোমের সহায়তায় আটকে পড়া এক নারী রাইটস যশোর নামক বাংলাদেশি এনজিওর সদস্যদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাঁকে উদ্ধারে সাহায্য চান। সংগঠনটি তাদের রেসকিউ টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে একজন নারীকে উদ্ধার করে।
রাইটস যশোরের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্থানীয় থানায় মামলা করতে গেলেও পুলিশ সে মামলা নিতে চায়নি। এর বছর খানেক পর ভারত থেকে সেই নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলেও নারীটি স্বস্তিতে নেই। কারণ পাচারকারীরা তাঁকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে নারী পাচারের ক্ষেত্রে পাচারকারীরা এখন ‘ভালো চাকরি’ দেওয়াকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করছে। ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভালো চাকরি দেওয়ার নামে কমবয়সি ও সুন্দরী নারীদের পাচারের জন্য টার্গেট করা হয়। তাঁদের হাসপাতাল, গার্মেন্ট, বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও পারলারে কাজ দেওয়ার নামে জোরপূর্বক ডিজে পার্টি, দেহব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
সূত্র জানান, সীমান্তে মানব পাচার রোধে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী এখন আগের চেয়ে সতর্ক। এরপরও নারী পাচারের ঘটনা থেমে নেই। এ ব্যাপারে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকাও খুব একটা বদলায়নি। সীমান্তবর্তী নারী ও কিশোরীরা বেশি পাচারের শিকার হন বলে ধারণা করা হলেও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নারী পাচারের ঘটনা ঘটছে। দরিদ্র পরিবারের অসহায়, ঝুঁকিপূর্ণ নারী ও কিশোরীরাই বেশি পাচারের শিকার হচ্ছেন। সাধারণত ভালো কাজের সুযোগসুবিধা দেওয়ার আশ্বাসে নারীদের দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত পাচারের শিকার নারীদের পরিণতি ভালো নয়। আগে ভারতের সোনাগাছিতে পাচারের ঘটনা সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন ভারতের সব জায়গায় বাংলাদেশ থেকে নারীদের পাচার করে অনৈতিক কার্যকলাপে বাধ্য করা হচ্ছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর হিসাবে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত অবৈধভাবে পাচারের সময় পাচারকারীসহ আটক ব্যক্তির সংখ্যা ১৪৫। এর মধ্যে নারী ও শিশু ৫৫ জন। হাসপাতালে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তিন বাংলাদেশি নারীকে ভারতের মুম্বাইয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ করানোর অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক খবরে জানা যায়, নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় পুলিশ একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তিন নারীকে উদ্ধার করে। ওই নারীরা জানান, ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে মুম্বাই আনা হয় কিন্তু কাজ দেওয়ার বদলে তাঁদের দিয়ে করানো হচ্ছিল অসামাজিক কাজ। এই নারীদের অবৈধভাবে সীমান্ত পার করে নিয়ে আসা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারতীয় সীমান্তে কড়াকড়ির জন্য আগের তুলনায় পাচারকারীরা বেশি অর্থে নারী পাচার করছে। আগে যেখানে পাচারকারী বা দালালরা মাথাপিছু শুধু সীমান্ত পার করতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা নিত এখন তা ৩০ থেকে ৪০ হাজারে ঠেকেছে। আবার ভারতের পতিতালয়ে একজন নারীকে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের দালালরা ভারতের দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই অর্থ লেনদেন করছে। সাধারণত ১২ বছরের কিশোরী থেকে ৩০ বছর নারীরা বেশি পাচারের শিকার হচ্ছেন। রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাচার ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে এমইউ ছিল তা দেশটি মানছে না। এ ব্যাপারে ভারত সরকার তাদের পাচার নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওগুলোকে এখন তথ্য দিচ্ছে না। আগে এই এনজিও বা সেফ হোমগুলো যেমন বাংলাদেশের পাচার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করত, এখন তা করছে না। এখন এসব তথ্য ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে। কিন্তু হাইকমিশন এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের সঙ্গে ‘চোর-পুলিশ’ খেলছে। আমাদের এ-সংক্রান্ত তথ্য জানাচ্ছে না। এতে পাচারের প্রকৃত তথ্য সামনে আসছে না।’