চট্টগ্রামের রক্তাক্ত বাঁশখালীর গণ্ডামারা এখন আতঙ্ক, শোক ও ক্ষোভের জনপদ। বাঁশখালী উপজেলার আকাশ যেন শোকের কালো কাপড়ে ঢাকা। পুরো এলাকায় বিরাজ করছে আতঙ্ক। সামগ্রিক অবস্থা থমথমে। দায়ের হওয়া তিন মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার গ্রামবাসীকে। আতঙ্কে অনেকেই এখন এলাকাছাড়া।
এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও প্রকল্পের পক্ষ-বিপক্ষের গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলি বর্ষণের ঘটনায় মঙ্গলবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চারটি লাশের সন্ধান মিলেছে। তবে সোমবারের ওই সংঘর্ষে ছয়জন মারা গেছে বলে এলাকার অনেকে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই স্থানীয় নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ক্ষোভ ও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে পড়ে। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে হচ্ছে নীরব প্রতিবাদ সভা। অসংখ্য বঞ্চিত মানুষ প্রতিবাদ ও মানববন্ধন সভা করেছে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে। এ ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু নেপথ্যের মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
বাঁশখালী থানা সূত্রে জানা যায়, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও সরকারি লোকজনের ওপর হামলার ঘটনায় বাঁশখালী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাহার মিয়া বাদী হয়ে ৫৭ জনের নাম উল্লেখ ও প্রায় ৩২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা করেছেন। তাছাড়া নিহত দুই সহোদর ও জামাতার পরিবারের পক্ষে মাওলানা বশির আহমদ বাদী হয়ে ৬ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত ১৪০০ থেকে ১৫০০ জনকে জনকে আসামি করে একটি এবং নিহত জাকের আহমদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে প্রায় ১৮০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) হাবিবুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাছাড়া এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করতে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকায় রয়েছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. মুমিনুর রশিদকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
বসতভিটা ও কবরস্থান রক্ষা কমিটির আহবায়ক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী বলেন, পরিকল্পিতভাবে পুলিশ জনগণের উপর গুলি চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। আমরা রক্তের বিনিময়ে হলেও চার নিহতের রক্তের দাম বৃথা যেতে দেব না। আমাদের বাপ-দাদার ভিটা মাটি ছেড়ে যাব কোথায়? তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, পুলিশ প্রশাসন প্রকল্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নেপথ্যে আতাত করে জনস্বার্থ ও পরিবেশ বিরোধী একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে মাঠে নেমেছে। আমরা জীবন দিয়ে হলেও এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে দেব না।
গ্রেফতার তিন
বাঁশখালী ঘটনায় পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন, আবদুল খালেক (২৪), জহিরুল ইসলাম (৪০), মহিউদ্দিন (২০)। তারা সকলেই উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের বাসিন্দা। এর মধ্যে দুইজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ স্বপন কুমার মজুমদার বলেন, এ ঘটনায় পুলিশের ওপর গুলি ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়া মামলার অন্য আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১৪
বাঁশখালীর রক্তাক্ত ঘটনায় আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ক্যাজুয়াল্টি, ১৯ ও ২৬ ওয়ার্ডে পুলিশের ৪ সদস্যসহ মোট ১৪ জন চিকিৎসাধীন আছেন। আহতরা হলেন- মুজিবুর রহমান (২০), আনসার উদ্দিন (৩০), জহির আলম (৩০), আবদুল খালেক (২৫), আবু খান (৫০), মোতালেব ২৩, নুরুল ইসলাম (১৮)। পুলিশ সদস্যের মধ্যে আছেন মিরাজ উদ্দিন (২৮), নুরুল কবির (২৯), ওয়াসিম (২২), কনক চন্দ্র সিংহ (২৪)। তাছাড়া তিনজনের কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়নি বলে হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ি সূত্রে জানা যায়।
বাঁশখালীর ঘটনায় নিহতরা হলেন গণ্ডামারা ইউনিয়নের চরপাড়ার আশরাফ আলী বাড়ির মরতুজা আলী (৩৫), জাকের আহমদ (৩৭), মো. আনোয়ারুল ইসলাম (৪৪), জাকের হোসেন (৩৫)। মঙ্গলবার চমেক হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে চারজনের ময়না তদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরো বেশি ছিল বলে দাবি করেছে নিহত ও আহতের স্বজনরা। তাদের লাশ 'গায়েব' করে ফেলা হয়েছে বলে তারা দাবি করেন।
সরেজমিন
মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার হাদীর পাড়া ও রহমানিয়া মাদরাসার মাঠ এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে রয়েছে পুলিশি হামলায় ভেঙে দেওয়া 'বসত ভিটা ও কবরস্থান রক্ষা কমিটি'র মাইক ও সিএনজি অটোরিকশা। মাঠের বিভিন্ন অংশে এখনো দেখা যাচ্ছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। রহমানিয়া মাদরাসার দেয়াল ও আশপাশের বিভিন্ন গাছে রয়েছে গুলির দাগ। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে চরম ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাড়িতে বাড়িতে পড়েছে কান্নার রোল। সংঘর্ষে আহতদের অনেকেই মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে নিজ ঘরেই চিকিৎসা নিচ্ছেন, কেউ আছেন পালিয়ে। অন্যদিকে, গত সোমবার রাত থেকেই গণ্ডামারা ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রবেশ পথে পাহারা বসিয়েছেন গ্রামবাসী। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে নেই, এমনটি নিশ্চিত হয়েই যাতায়াতকারীদের গ্রামে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্মিত প্রকল্প কার্যালয় এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তালাবদ্ধ দেখা যায়। দেখা যায়নি প্রকল্পের পাহারাদার ও আনসার সদস্যদেরও।
নিহতের স্বজনদের ক্ষোভ
নিহতের পরিবারে এখন চলছে শোকের মাতম। স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে তারা এখন পাথর হয়ে আছেন। নিহত আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রী কোহিনুর বেগম বলেন, আমার অবিবাহিত তিনটি মেয়ে ও এক ছেলে। তাদের নিয়ে এখন আমি কি করব? কি হবে আমার? তাদের খাওয়াবে কে? লেখা পড়ার কি হবে? এ সময় তার তিন মেয়ের চোখে মুখেও হতাশার ছাপ দেখা যায়। নিহত মর্তুজা আলীর স্ত্রী নুর জাহান বলেন, আমার এক মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার। এর মধ্যে মেয়ে আফসারা বেগমের বিয়ে হলেও দুই ছেলে এখনো ছোট। এখন আমার মেয়ের সংসার কে চালাবে? কে চালাবে আমার সংসার?
প্রসঙ্গত, গত সোমবার বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা ইউনিয়নের হাজীপাড়া স্কুল মাঠে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে সমাবেশ আহবান করেন স্থানীয়রা। কিন্তু সমাবেশ শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে স্থানীয় এমপির পক্ষে মাইকিং করে পাল্টা সমাবেশের ডাক দেয় অপর পক্ষ। একই স্থানে দুটি সমাবেশের ডাক দেওয়ায় উত্তেজনা সৃষ্টির শঙ্কায় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। এ সময় চরম উত্তেজনার এক পর্যায়ে পুলিশ ও জনতা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পুলিশ উপস্থিত জনতার ওপর এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। পুলিশের সঙ্গে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পক্ষের লোকজনও গুলি বর্ষণ করে বলে স্থানীয়রা জানান। এ ঘটনায় চারজন নিহত ও অর্ধশত মানুষ আহত হন।
অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরেই বাঁশখালিতে এস আলম গ্রুপের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের জমি দখলের অভিযোগ উঠছে। আর তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছিল।
জানা যায়, বেসরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর গণ্ডামারা পশ্চিম বড়ঘোনায়। চায়না সেবকো এইচটিজির সঙ্গে যৌথভাবে ৬০০ একর জমির ওপর ২০ হাজার কোটি টাকার এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে এস আলম গ্রুপ। কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের এ বিদুৎ কেন্দ্রের ৭০ শতাংশের মালিকানা এস আলম গ্রুপের, ৩০ শতাংশের মালিকানায় চীনা প্রতিষ্ঠানের। বিনিয়োগ করা ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার মালিকানা ও ঋণ দিচ্ছে চীনের প্রতিষ্ঠান দুটি।
বিডি-প্রতিদিন/০৫ এপ্রিল ২০১৬/ এস আহমেদ