২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্রমুক্ত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার ইস্যুকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক শান্তি এবং মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নেও সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এমন অভিমত পোষণ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে এসডিজির অগ্রগতি আলোকে ৩ দিনব্যাপী শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরাম (হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরাম তথা এইচএলপিএফ) এর প্রথম দিন সোমবার মহাসচিব আরো উল্লেখ করেন, এসডিজির অনেক বিষয়েই গত দু’বছরের অগ্রগতি সন্তোষজনক হলেও বেশ কিছু ইস্যুতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন মহাসচিব। যদিও বাংলাদেশের বক্তব্য উপস্থাপনের পর মন্ত্রী পর্যায়ের এই শীর্ষ সম্মেলনের সকলেই আশাবাদি হয়ে উঠেন। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও বাংলাদেশ এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত আস্থার সাথে কাজ করছে বলে উল্লেখ করা হয়।
‘ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউ’ (ভিএনআর) সেশনে “ইরাডিকেটিং পোভার্টি এ্যান্ড প্রমোটিং প্রোসপারিটি ইন এ চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড” শির্ষক এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ক বাংলাদেশের জাতীয় রির্পোট উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ সরকারের এসডিজি বাস্তবায়নের মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ। মন্ত্রী পর্যায়ের এই সেগমেন্টে ৪৪টি দেশ তাদের ন্যাশনাল রির্পোট উপস্থাপন করছে। এ পর্বে বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মূলমঞ্চে উপবেশন করেন অন্যতম প্যানেলিস্ট হিসেবে। তিনি বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের পক্ষ থেকে উপস্থিত সকলকে শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় রির্পোট উপস্থাপন করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব ও বর্তমানে প্রধান সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদকে বিপুল করতালির মধ্যে আহবান জানান ।
এ সময় বাংলাদেশের অগ্রগতির সমর্থনে বড় পর্দায় নানা অনুষ্ঠান ও কর্মকান্ডের ছবি ভেসে উঠে। অর্থাৎ একটি মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে গত দুই বছরে এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতির এই রির্পোট অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করার সময় আবুল কালাম আজাদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্নের সোনার বাংলা রচনায় তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বিচক্ষণতাপূর্ণ নেতৃত্বে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ বলেও উল্লেখ করেন।
এ সময় এসডিজি’র ৭টি অভীষ্ট লক্ষ্য যথা: দারিদ্র্য নির্মূল (অভীষ্ট-১), ক্ষুধা (অভীষ্ট-২), সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ (অভীষ্ট-৩), লিঙ্গ সমতা (অভীষ্ট-৫), শিল্প উদ্ভাবন ও অবকাঠামো (অভীষ্ট-৯), জলজ জীবন (অভীষ্ট-১৪) ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব (অভীষ্ট-১৭) বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অর্জনসমূহ উল্লেখ করা হয়।
এসডিজিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসেবে উল্লেখ করে এর বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার গৃহীত বিভিন্ন কৌশল যেমন- সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজিকে সন্নিবেশিত করা, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে এসডিজিকে অন্তর্ভুক্ত করা, এসডিজি ট্র্যাকার সৃষ্টি, আন্ত:মন্ত্রণালয় এসডিজি বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কমিটি গঠন, মন্ত্রণালয়ের ম্যাপিং এবং ডেটাগ্যাপ এনালাইসিস এর মতো বিষয়গুলোও এখানে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করা হয়।
বাংলাদেশের উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধির তথ্য প্রদর্শন করা হয়। দেখানো হয় উচ্চ ও নিম্ন দারিদ্র্য রেখা যথাক্রমে ২৪.০৩% ও ১২.০৯% ভাগে নেমে এসেছে, যা ১৯৯১ সালে ছিল যথাক্রমে ৫৬.০৭% ও ৪১.০১%। প্রধানমন্ত্রীর প্রাধিকার প্রকল্প একটি বাড়ি একটি খামারের পাশাপাশি উঠে আসে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ, ডিজিটাল ফিনানসিয়াল সার্ভিস এবং জনগণের দোরগোড়ায় সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গৃহীত বিশেষ বিশেষ কর্মসূচিগুলো। পদ্মা সেতুসহ মেগা অবকাঠামো প্রকল্পসমূহও এ রির্পোটে স্থান পায়।
বাংলাদেশকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫টি ভিশন, যথা: ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা, ২০৩০ সালে এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত হওয়া, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়া, ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময়ে পরিণত করা এবং ২১০০ সালে ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নিরাপদ ব-দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলা- এ রিপোর্টে সন্নিবেশিত হয়।
এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কোন অবস্থানে রয়েছে, চ্যালেঞ্জসমূহ কী এবং এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশলসমূহ প্রতিফলনের পাশাপাশি এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এই রিপোর্টে।
এর আগে সকাল নয়টায় জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ এইচএলপিএফ-এর মন্ত্রী পর্যায়ের সেগমেন্ট উদ্বোধন করেন। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইকোসকের প্রেসিডেন্ট ফ্রেডলিক মুছিইওয়া ম্যাকামুরে সাভা।
জাতিসংঘ মহাসচিবের পাশাপাশি বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রেসিডেন্ট পিটার থমসন। বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রীর নেতৃত্বে ২২ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
দিনের শুরুতে সোমবার সকাল ৮:১৫ মিনিটে বাংলাদেশ, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডের যৌথ আয়োজনে “রিচিং দ্যা এসডিজিস বাই মিনস অফ দ্যা প্রাইভেট সেক্টর: হাউ গভার্নমেন্টস ক্যান ফোস্টার প্রাইভেট সেক্টর কন্ট্রিবিউশনস টু দ্যা ২০৩০ এজেন্ডা” শীর্ষক সাইড ইভেন্টে অংশ নেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এসডিজি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে “কেউ পিছনে পড়ে থাকবেনা” মর্মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির পুনরুল্লেখ করে পরিকল্পনা মন্ত্রী এ ইভেন্টে প্রদত্ত বক্তৃতায় বলেন,“এসডিজি’র লক্ষসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের নিবিড় সম্পৃক্ততা অত্যন্ত প্রয়োজন। এসডিজি অর্জনে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ত্বরান্বিত করতে আমরা তিনটি বিষয়ের উপর জোর দিয়েছি, তা হলো: ১) ব্যবসা খাতকে উৎসাহিত করতে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ তৈরি, ২) ট্যাক্স ও ভর্তূকি নীতিমালার মাধ্যমে বেসরকারি খাতকে প্রনোদনা প্রদান, এবং ৩) বহুজাতিক কোম্পানীর সামাজিক দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ”। পরিকল্পনা মন্ত্রী আরও বলেন, “দেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ৭৭% বেসরকারি খাত থেকে আসে। বিদ্যুৎ সেক্টরে এ খাতের অংশগ্রহণ ৪৫%। আমাদের সরকার বেসরকারি খাতের পূর্ণ বিকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”।
এছাড়া পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ফাস্ট ট্র্যাকিং পোভার্টি ইরাডিকেশন এন্ড এসডিজিস থ্রু দ্যা ডেটা রেভ্যুলেশন’ শীর্ষক সাইড ইভেন্টেও অংশ নেন।
এসডিজি বাস্তবায়নের মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ সঞ্চালিত এ অনুষ্ঠানে প্যানেলিস্ট হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এস্তোনিয়ার পরিবেশ বিষয়ক উপমন্ত্রী আডো লোহ্মুজ, নেপালের পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান এবং জাতিসংঘ ও ইউএনডিপি’র উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ।
অনুষ্ঠানটিতে একটি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের তথ্য বিপ্লবের (ডিজিটাল বাংলাদেশ) বিষয়টি তুলে ধরা হয় এবং এটি এসডিজি বাস্তবায়নে ও দারিদ্র্য দূরীকরণে কিভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে তা অবহিত করা হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী রাতে জিপিইডিসি’র কো-চেয়ার হিসেবে জার্মানি ও উগান্ডার মন্ত্রীবর্গসহযোগে একটি নৈশভোজ আয়োজন করেন।
এইচএলপিএফ-এর দিনব্যাপী কর্মসূচিতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, পরিকল্পনা কমিশনের জেনারেল ইকোনোমিকস ডিভিশনের সদস্য শামসুল আলম ও পিকেএসএফ-এর মহাপরিচালক আব্দুল করিম, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) এন এম জিয়াউল আলম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জিআইইউ এর মহাপরিচালক আব্দুল হালিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই- এর পলিসি এ্যাডভাইজর আনীর চৌধুরীও ছিলেন।
এক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যা ও সংকট রয়েছে, সে সব সবিস্তারে স্বেচ্ছায় উপস্থাপন করার অঙ্গিকার থেকেই এ ফোরাম অনুষ্ঠিত হবে।
এ সময় জাতিসংঘের সমন্বয় করা তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত সারাবিশ্বের এক বিলিয়ন মানুষকে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে থেকে বের করে আনা সম্ভব হলেও ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৭৬৭ মিলিয়ন তথা ৭৬ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছিলো। অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়েসী অসংখ্য শিশুর জীবন-মানের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হলেও এখনও অনেক শিশু অপুষ্টির শিকার রয়েছে। ২০১৬ সালে এমন শিশুর সংখ্যা ছিল ১৫৫ মিলিয়ন তথা ১৫ কোটি ৫০ লাখ।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বিশ্বে সন্তান প্রসবের সময় মায়ের মৃত্যুর হার ৩৭% হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে এবং অনূর্দ্ধ ৫ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার কমানো হয়েছে ৪৪%। যদিও ২০১৫ সালে ৩ লাখ ৩ হাজার গর্ভবতী মহিলার প্রাণহানী ঘটেছে। এ বছর অনূর্ধ্ব ৫ বছরের ৫৯ লাখ শিশুর মারা গেছে চিকিৎসা সংকটে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, টেকসই জ্বালানীর ক্ষেত্রে ২০১৪ সালে রান্নার কাজে বিশুদ্ধ জ্বালানী ও টেকনোলজির ব্যবহার বাড়ে ৫৭%। ২০০০ সালে এ হার ছিল ৫০%। ২০০০ সালে বিশ্বের ৩ বিলিয়ন মানুষই বিশুদ্ধ জ্বালানীর ব্যাপারে সজাগ ছিলেন না। ২০১২ সালে জ্বালানী বিভ্রাটে প্রাণহানী ঘটে ৪.৩ মিলিয়ন তথা ৪৩ লাখ মানুষের। মানুষের জীবন-মানের উন্নয়নে আগের বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় ৮.৯%, অর্থের পরিমাণে যা ছিল ১৪২.৬ বিলিয়ন ডলার। যদিও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে দ্বি-পাক্ষিক সহায়তার পরিমাণ কমেছে ৩.৯%।
বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন