২৮ মে, ২০২২ ০০:৪৩

সম্মেলন করতে টালবাহানায় সহযোগীরা

নেতৃত্ব ছাড়তে চায় না যুব মহিলা লীগ-মহিলা আওয়ামী লীগ, বেপরোয়া ছাত্রলীগ, শেষ মুহূর্তে প্রেস রিলিজ কমিটিতে বাণিজ্যের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সম্মেলন করতে টালবাহানায় সহযোগীরা

গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় আগামী ডিসেম্বরের আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলন করা হবে। ১০ মে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে সহযোগী ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় মেয়াদোত্তীর্ণ তিন সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনার পর ২০ দিন অতিবাহিত হলেও ছাত্রলীগের কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। বরং তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। শেষ মুহূর্তে বিভিন্ন জায়গায় প্রেস রিলিজ কমিটিতে বাণিজ্যে জড়িয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগ সম্মেলনের কার্যকর উদ্যোগ না নিলেও তারা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ চেয়েছেন। দলের একাধিক সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্মেলনের নির্দেশনা দিলেও গড়িমসি করছে। কারণ হিসেবে সামনে জুন মাসে বাজেট অধিবেশন থাকে, এ ছাড়াও জুন-জুলাই মাসে বৃষ্টির মৌসুম। সামনে কোরবানির ঈদ আছে। আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ শোকের কর্মসূচি পালন করে। সে কারণে সম্মেলন হবে না। এসব নানা টালবাহানায় আগামী ডিসেম্বরে ‘ক্ষমতা’ ছাড়তে চান তারা। তবে যুব মহিলা লীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রীরা বলছেন, আমরা প্রস্তুত। নেত্রী সময় দিলেই সম্মেলন হবে।

এ প্রসঙ্গে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত। নেত্রী যখনই আমাদের সময় দেবেন তখনই আমরা সম্মেলন করতে সক্ষম। আমাদের জেলা-উপজেলায় পুরোদমে সম্মেলন চলছে। সম্মেলনের নির্দেশনা পাওয়ার পর সংগঠনের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক করে দায়িত্বও ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।’ 

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৪ মার্চ সম্মেলনের মাধ্যমে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন সাফিয়া খাতুন, সাধারণ সম্পাদক হন মাহমুদা বেগম। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ সংগঠনের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুব মহিলা লীগের প্রথম জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল ২০০৪ সালের ৫ মার্চ। তখন নাজমা আক্তারকে সভাপতি ও অপু উকিলকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি করা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ১৭ মার্চ সংগঠনটির দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি পদে নাজমা আক্তার ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অপু উকিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনর্নির্বাচিত হন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এ সংগঠনেরও মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে। তারাও দায়িত্ব ছাড়তে চান না বলে যুব মহিলা লীগের পদপ্রত্যাশী একাধিক নেত্রীর অভিযোগ।

তবে সংগঠনের অভিভাবক, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন সময় দেবেন তখনই সম্মেলন করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন অপু উকিল। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছি। সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রী যখনই সময় দেবেন, তখনই আমরা সম্মেলন করব। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে।’ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগ আওয়ামী লীগের দফতরে যোগাযোগ করে দলীয় সভানেত্রীর সাক্ষাৎ চেয়ে পত্র দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন সময় দেবেন, তখন তারা যাবেন।’

কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ : সম্মেলন পেছাতে নতুন কৌশলে হাঁটছে ছাত্রলীগ। সম্মেলনের জন্য যেন বেশি তাগাদা দেওয়া না হয় সেজন্য তারা ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে বলে সন্দেহ খোদ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরামের একাধিক নেতার। সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ছাত্রদলের বিশেষ সখ্য থাকায় এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। শুধু ঢাকায়ই নয়, সারা দেশেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে শেষ মুহূর্তে চলছে কমিটি বাণিজ্য।

জানা গেছে, অতিসম্প্রতি সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রে ১৫১ জনের জেলা কমিটি হওয়ার কথা। কিন্তু করা হয়েছে ২৯৪ জনের ঢাউস কমিটি। গঠনতন্ত্রে আছে সহসভাপতি ২১ জন; কিন্তু এই পদ দেওয়া হয়েছে ৭৭ জনকে। যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদক ৯ জন করে রাখার নিয়ম থাকলেও ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১১ জন করে উভয় পদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা জেলা দক্ষিণ ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়া হয়েছে ২০৫ সদস্যবিশিষ্ট। এখানে গঠনতন্ত্রের সব ধারারই ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। ২১ জন সহসভাপতি পদের বিপরীতে ৪৪ জন। আবার গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে শ্রীপুর উপজেলার তেলীহাটি ইউনিয়ন থেকে।

এসব অনিয়ম যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্যের কমিটিতে। ইডেনে বিবাহিত ছাত্রীদেরও রাখা হয়েছে কমিটিতে। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন পদবঞ্চিতরা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ছিল সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি করে সংগঠনকে ঢেলে সাজানো ও শক্তিশালী করা। কিন্তু উল্টোরথে চলছেন বর্তমান দুই নেতা। দ্রুততম সময়ে সম্মেলন দিয়ে কমিটি করতে নির্দেশনা থাকলেও কেন্দ্রীয় সম্মেলন করতে নানা টালবাহানা করছেন জয়-লেখক। এ নিয়ে গত শনিবার মধুর ক্যান্টিনে তোপের মুখে পড়েন তারা। কেন্দ্রীয় সম্মেলন ঘনিয়ে আসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রেস রিলিজ কমিটি গঠনের হিড়িক পড়েছে। অতি সম্প্রতি ঢাকার তিনটি কলেজে কমিটি দেওয়া হয়েছে।

ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, বিভিন্ন ইউনিটে সম্মেলনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নয়, প্রেস রিলিজ কমিটিতে ব্যস্ত ছাত্রলীগ। এর মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্ব কমিটিবাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠছে। প্রেস রিলিজ কমিটিতেও মানা হচ্ছে না গঠনতন্ত্র। ঢাকায় বসে ফেসবুকে দেওয়া হচ্ছে জেলা-উপজেলা কমিটি। জেলা কমিটি ১৫১ করার কথা গঠণতন্ত্রে থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। কোথায়ও ৩০০, কোথাও ৩৫০, কোথাও আড়াই শ’ জনের কমিটি করা হচ্ছে। প্রেস রিলিজ কমিটি নিয়ে রয়েছে অর্থ লেনদেনসহ বিস্তর অভিযোগ। অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা। তারা দাবি করেছেন, অর্থ লেনদেনসহ কোনো অভিযোগ প্রমাণ দিতে পারলে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন।

এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগ সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কোনো কমিটিবাণিজ্য হয়নি। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। ন্যূনতম অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াব।’

তিনি বলেন, আমাদের আগেও যারা দায়িত্বে ছিলেন তারাও সম্মেলন শেষ করে ঢাকায় ফিরে এসে কমিটি দিয়েছেন। আর কমিটি যখন দিতে হয়, তখন প্রেস রিলিজেই দেওয়া হয়। কোনো ব্যত্যয় ঘটছে না। আর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘করোনার কারণে অনেক জেলায় সম্মেলন করতে পারিনি। আবার কোথাও কোথাও সম্মেলন করেছি। শেষ মুহূর্তে এসে কমিটি করছি বলে অনেকেই উড়ো অভিযোগ দিচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠন করা হচ্ছে। কোথাও কোনো অনিয়ম হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, সভাপতি-সম্পাদক পদে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকে। কিন্তু পদ দুটো। যখনই কেউ পদে আসতে পারে না, তখনই নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। যার পুরোটাই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

২০১৮ সালের ১১ ও ১২ মে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়। এর দুই মাস পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই গঠিত হয় কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদ। ছাত্রলীগ সভাপতি নির্বাচিত হন রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক হন গোলাম রাব্বানী। তবে এক বছর গড়াতেই অনিয়ম ও চাঁদাবাজির অভিযোগে শোভন-রাব্বানীকে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর অপসারণ করা হয়। শোভন-রাব্বানীকে অপসারণের পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এক নম্বর সহসভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়কে সভাপতি ও এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কয়েক মাস ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও ২০২০ সালের ৪ জানুয়ারি তাদের ভারমুক্ত করে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিকে করোনা মহামারি ও বন্যাসহ বিভিন্ন সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়ালেও সাংগঠনিক কার্যক্রম গোছাতে পারেননি নতুন নেতারা।

আসন্ন রংপুর জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে মাদক মামলায় আটক ও বয়স্ক ব্যক্তিকে শীর্ষ পদ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মাদকসহ আটক ও বয়স্ক ব্যক্তিকে বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে নেতা বানানো হচ্ছে বলে রংপুর জেলা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতার অভিযোগ। ওই ব্যক্তির নাম সোহেল রানা সানি।

মাদক মামলায় আটক হওয়া প্রসঙ্গে সানি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ছোট ভাইয়েরা আমার মোটরসাইকেল নিয়ে লালমনিরহাট যায়। সেখান থেকে আমার মোটরসাইকেল আটক করে ডিবি পুলিশ কাগজপত্র নিয়ে যেতে বলে। সেখানে গেলে আমাকে আটক দেখানো হয়। পরের দিন একটা ফেনসিডিলের খালি বোতল দেখিয়ে ছবি তোলা হয়। পরবর্তীতে ছাত্রলীগ আমাকে বহিষ্কার করে। আমি জামিন নিয়ে ড্রাগ টেস্ট করিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে দিলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।’

বয়স বেশি প্রসঙ্গে সানি আরও বলেন, প্রথম যখন জন্মনিবন্ধন এবং ভোটার আইডি কার্ড করা হয়, সেখানে আমার জন্মতারিখ ভুল ছিল। পরে সংশোধন করেছি। জয়-লেখক দায়িত্ব পাওয়ার পর যেসব কমিটি করা হয়েছে অধিকাংশই বাণিজ্যের ফসল বলে অভিযোগ উঠেছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে সাদ্দাম হোসেনকে সভাপতি ও মারুফ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে বড় ধরনের বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে সেই সময়ে। সাদ্দাম হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি এবং তার বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগ উঠেছিল। তারাই এতই অজনপ্রিয় যে, কমিটি ঘোষণা হওয়ার ২৫ দিন পর তারা যৌথভাবে এলাকায় ফেরেন।

একই অবস্থা ছিল সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে সড়ক অবরোধ ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রলীগের একটি অংশ। অর্থের বিনিময়ে কমিটির শীর্ষপদ বিক্রির অভিযোগ আনেন তারা। এভাবে কমিটি করায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের এক অংশও ক্ষোভ প্রকাশ করে। এভাবে কমিটি ঘোষণা করাকে তারা গঠনতন্ত্রবিরোধী আখ্যা দিয়েছেন।

এদিন এর প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে দুই সদস্য পদত্যাগও করেন। এর আগে ৩০ জুলাই ঠাকুরগাঁও জেলা ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি। রাতে ঘোষণার পর কমিটিতে জায়গা না পাওয়া নেতারা বিক্ষোভ করেন। 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর