আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ ও কেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদার করতে সর্বাধুনিক বডি ওর্ন ক্যামেরা (বডিক্যাম) ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের দেহে এসব ক্যামেরা বসানো থাকবে। সারা দেশে ৪৭ হাজার ভোটকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বডিক্যাম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তবে বাস্তবে এখনো খুব বেশি দূর অগ্রসর হয়নি ক্যামেরা কেনার প্রক্রিয়া। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের আগে মানসম্পন্ন ও কার্যকর বডি ওর্ন ক্যামেরা সংগ্রহ করা যাবে কিনা-তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিগগিরই সঠিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন (ফিচার) ক্যামেরা নির্বাচন করা না হলে, শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে নিম্নমানের যন্ত্র সরবরাহের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ তৈয়ব আহমেদ বলেছেন, ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা-যা সাধারণত বডিক্যাম নামে পরিচিত, সংগ্রহের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এই ডিভাইসগুলো হাজার হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করবে। আমরা অক্টোবরের মধ্যে বডিক্যামগুলো সংগ্রহ করতে চাই, যেন পুলিশ বাহিনী এসকল বডিক্যামের এআই সক্ষমতাসহ মূল বৈশিষ্ট্যগুলোর উপর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেতে পারেন।
জানা গেছে, পুলিশের কাজে স্বচ্ছতা আনতে সর্বাধুনিক বডি ক্যামেরা সংযোজনের সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। তার ভিত্তিতেই এই যন্ত্র কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এসব ক্যামেরা ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কেন্দ্রে দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের বুকে এই যন্ত্র লাগানো থাকবে। এসব ক্যামেরায় ভিডিও, অডিও, অ্যালার্ম সিস্টেম থাকবে। এই ডিভাইসের মাধ্যমে ভিডিও ধারণের পাশাপাশি সরাসরি দেখারও ব্যবস্থা থাকবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে পুলিশের বডি ক্যামেরার মাধ্যমে পাওয়া ভিডিও তিনটি স্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে পুলিশ ফোর্সের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হবে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে জেলায় সক্রিয় সবগুলো বডি ক্যামেরা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর সারাদেশে বডিক্যাম কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। কোনো ভোটকেন্দ্র বা এলাকায় সমস্যা দেখা দিলে এই বডিক্যামের মাধ্যমে থানা, জেলা ও কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেন্টারে সংকেত পাঠাবে। শুধু তাই নয়, বডি ক্যামেরায় মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হবে। এই প্রযুক্তির কারণে কেন্দ্র দখল, জাল ভোটসহ পেশিশক্তির মাধ্যমে ফলাফলে প্রভাবিত করার আশঙ্কা অনেকটা কমে যাবে বলে।
তবে কাগজে-কলমে এতোসব পরিকল্পনা করা হলেও সঠিক সময়ে মানসম্পন্ন বডি ক্যামেরা সংগ্রহ করা যাবে কিনা-তা নিয়েই বেশ সংশয় তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচনের মাত্র ৬ মাস বাকি থাকলেও এখনো বডি ক্যামেরা ক্রয়-প্রক্রিয়া একবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। শুধু তাই নয়, ডিভাইস চূড়ান্ত না হওয়ায় বডি ক্যামেরা ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু করা যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তিগত নানা দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বডি ক্যামেরা চূড়ান্ত করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কাজ করছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী বিষয়টি তদারকি করছেন। এছাড়া বডি ক্যামেরা সংগ্রহের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি ক্রয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ছাড়াও এই কমিটিতে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব, পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (ফাইন্যান্স), অতিরিক্ত আইজিপি (লজিস্টিকস অ্যান্ড অ্যাসেট একুইজিশন), অতিরিক্ত আইজিপিসহ (পুলিশ টেলিকম) কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি।
তবে অতীতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় বডি ক্যামেরা ক্রয় প্রক্রিয়ায় পুলিশের কোনো কর্মকর্তা এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকতে চাইছেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, বডিক্যাম সরবরাহে আগ্রহীদের মধ্যে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত একাধিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে পুলিশের জন্য প্রায় ১০ হাজার বডি ওর্ন ক্যামেরা কেনা হয়েছিল। তবে স্থানীয় সরবরাহকারীরা নিম্নমানের বডি ক্যামেরা গছিয়ে দেওয়ায় তা কাজে আসেনি। তারা ধাপে ধাপে এই ক্যমেরাগুলো সরবরাহ করেছিল। শুধু তাই নয়, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের যোগশাজশে ওই প্রতিষ্ঠানটি পুলিশের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম করে কয়েক শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ বিতর্কিত সেই প্রতিষ্ঠানটি এবারো বডিক্যাম সরবরাহের কাজ পেতে তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে বডিক্যাম নিয়ে যাতে অতীতের মতো কোনো প্রশ্ন না উঠে- সে বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সচেতন রয়েছেন বলে জানা গেছে।
একইভাবে বডি ক্যামেরা সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নিতে উঠেপড়ে লেগেছে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ আমলে আইসিটি সংক্রান্ত কাজে এই প্রতিষ্ঠান আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। একের পর এক প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে সরকারের বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিলেও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাজ না করার অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রকল্পের কাজ পায়। এক্ষেত্রে বিদেশ থেকে উন্নতমানের কার্ড তৈরি করে আনার কথা থাকলেও স্থানীয়ভাবে নিম্নমানের কার্ড বানিয়ে সরবরাহ করে। সেগুলো এতই মানহীন ছিল যে, পরবর্তীতে নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
বডি ক্যামেরা ক্রয় প্রক্রিয়া এবং পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে পুলিশ টেলিকমের অতিরিক্ত আইজিপি একেএম আওলাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বিডি প্রতিদিন/এমআই