জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিচার বিভাগ সংস্কারে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ যে ‘রোডম্যাপ’ ঘোষণা করেছিলেন, এক বছরে তার প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট।
শনিবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম। এক বছরে রোডম্যাপের কী কী বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
গত বছরের ১০ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিক্ষোভের মুখে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
ওই দিন রাতে হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। পরদিন তিনি শপথ নেন। বিচার বিভাগের দায়িত্ব নিয়েই রেফাত আহমেদ ‘প্রকৃত স্বাধীন বিচার বিভাগ’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন।
গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার গার্ডেনে অধস্তন আদালতের বিচারকদের অভিভাষণ দেন বিচার বিভাগের প্রধান।
অভিভাষণে তিনি স্বাধীন-স্বতন্ত্র বিচার বিভাগের গুরুত্ব তুলে ধরে বিচার বিভাগ সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। এক বছরে রোডম্যাপের কিছু উল্লেখযোগ্য বাস্তবায়ন তুলে ধরা হলো :
বিচারক নিয়োগে আইন : রোডম্যাপের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে একটি সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন। সে জন্য আইনের একটি খসড়া তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান সুপ্রিম কোর্ট। এই খসড়ার ভিত্তিতেই স্থায়ী ও স্বতন্ত্র ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’-এর বিধান রেখে গত ২১ জানুয়ারি ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত ২৫ আগস্ট ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল’-এর মাধ্যমে বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম হাইকোর্টে ২৫ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় : বিচার বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অধস্তন আদালতে বিচারক নিয়োগ, পদায়ন, বদলিসহ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ, সবিচালয়ের সংগঠনিক কাঠামো গত বছরের ২৭ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান সুপ্রিম কোর্ট। বিষয়টি উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট এক রায়ে তিন মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের জন্য স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার এর আইনি কাঠামো তৈরি করেছে।
পেপার-ফ্রি বেঞ্চ চালু : বিচারিক কাজ আধুনিক করতে নেওয়া পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে ‘পেপার-ফ্রি বেঞ্চ’ চালু।হাইকোর্টের একটি কম্পানি বেঞ্চ গত ২ জানুয়ারি থেকে কাগজবিহীন (পেপার-ফ্রি) বিচারকাজ চালিয়ে আসছেন।
হেল্পলাইন চালু : বিচারিক সেবায় সাধারণ মানুষের অভিগম্যতা বাড়াতে সুপ্রিম কোর্টে দুটি হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হেল্পলাইন থেকে সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। গত বছর ২৫ সেপ্টেম্বর এই সেবা চালুর পর ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন হাজার ৭২টি কল আসে। এর মধ্যে আইনি পরামর্শ চেয়ে কল করেন এক হাজার ৬৬৭ জন। আর বিভিন্ন মামলার তথ্য জানতে কল করেছেন এক হাজার ১৫৭ জন।
আসামিকে আইনি সহায়তা : জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০২৪-এর ২(১)(থ) অনুসারে কোনো বিশেষ পরিস্থিতির কারণে আদালতে আসামি যদি আইনজীবী নিয়োগ দিতে না পারেন, তাহলে ওই আসামিকে অসমর্থ ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করে লিগ্যাল এইডের আইনজীবী প্যানেল থেকে তাঁর পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এটি বাস্তবায়িত হয়েছে।
জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা : ২০০৭ সালের বিধিমালা রহিত করে গত ২৮ জুলাই বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়।
ফেলোশিপ চালু : বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে সুপ্রিম কোর্ট ‘প্রধান বিচারপতি ফেলোশিপ নীতিমালা’র একটি খসড়া প্রস্তুত করে গত ২০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ফেলোশিপটি চালুর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি : দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিসহ বিচারিক সেবায় বিচারপ্রার্থীদের অভিগম্যতা বাড়াতে অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর বিকল্প নেই। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালার অধীনে ‘বিচারিক পদ সৃজন’ গঠিত কমিটি এ বিষয়ে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর জেলা ও দায়রা জজ পর্যায়ে ১৯১টি পদসহ মোট ২৩২টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল : সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অসদাচরণের অভিযোগ তদন্ত ও অপসারণসংক্রান্ত সাংবিধানিক ফোরাম সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর রাষ্ট্রপতি দুজন বিচারপতিকে অপসারণ করেছেন।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংস্কার, বিচারকদের সুদমুক্ত গাড়ি সুবিধা, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পে কমিশন পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।
বিডি প্রতিদিন/মুসা