অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য যেখানে ওপেন সিক্রেট। মিলেমিশে চলে ঠিকাদারি ব্যবসা। হয়ে উঠেছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসরদের পুনর্বাসন ও স্বজনপ্রীতির কেন্দ্র। সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)। যা শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি।
দেশের একমাত্র সরকারি স্বায়ত্তশাসিত ওষুধ প্রস্তুতকারী এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্তার বিরুদ্ধেই এমন সব গুরুতর অভিযোগ এখন সবার মুখে মুখে। সৌভাগ্যবান এই কর্মকর্তার নাম মো. এ. সামাদ মৃধা। যিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকও বটে। ইতোমধ্যে এই মৃধার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, টেন্ডার বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, ছাঁটাই বাণিজ্য, নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন এবং অর্থ লোপাটের অভিযোগ সরকারের স্বায়ত্তশাসিত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটিকে আরও বিতর্কিত করেছে। অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় তিনি এসব অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল উত্তর দিতে নারাজ। বরং অনেকটা আস্ফালন করে বলেন, আমার কাছে এসব অভিযোগ তুলে কোনো লাভ নেই। চাকরি না থাকলে কোনো সমস্যা নেই ফের যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাব।
পিকনিক পার্টির নামে অর্থ লোপাট
প্রতিষ্ঠানটির খুলনা এসেনসিয়াল ল্যাটেক্স প্ল্যান্টের (কেইএলপি) ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বার্ষিক বনভোজন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা পিকনিক পার্টির আয়োজন করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি। এখানে বিভিন্ন খাতে খরচের নামে অর্থ লোপাট করা হয়েছে। পিকনিকের জন্য বরাদ্দ করা হয় ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭০ টাকা। খরচের হিসাব মেলাতে প্রস্তুত করা হয় ভুয়া বিল-ভাউচার। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন উপপ্রশাসনিক কর্মকর্তা শাপলা খাতুনের তত্ত্বাবধানে এ কারচুপি করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাপলা খাতুন বলেন, ‘আমি ভান্ডার কর্মকর্তা কোনো বিল-ভাউচার নিয়ে আমি কাজ করিনি বরং অ্যাডমিনের অহিদুল হাছানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি এ বিষয়ে বলতে পারবেন।’ তবে এ বিষয়ে শনিবার রাতে অহিদুল হাছান বাংলাদেশ প্রতিদিন কে বলেন, ‘পিকনিকের যাবতীয় দায়িত্বে ছিলেন শাপলা খাতুন। তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবে বিল-ভাউচার করা হয়েছে।’
সব ভাউচার বা খরচপত্র লেখা হয়েছে একই ব্যক্তির মাধ্যমে, যা রহস্যজনক।
আপ্যায়নের নামে খরচের ভাউচারে উল্লেখ করা হয়, খাসির মাংস ৫২০ কেজি, খাসির কলিজা ৪০ কেজি, গরুর মাংস ৩০ কেজি, আপেলের জুস ৪০ কেজি, ২০ কেজি আঙুর, প্রায় ১৬০ কেজি কমলা, ৫ হাজার ২০০ পিস মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয় ১ হাজার ৩২০ পিস এবং ৭২ পিস কোমল পানির ক্যান কেনা হয়। এছাড়া মাছ কেনা হয় ২৭৪ কেজি। এর মধ্যে ৬০ কেজি রূপচাঁদা, ১১৫ কেজি চিংড়ি, ৩৬ কেজি বোয়াল, ভেটকি ৪০ কেজি, ফাইস্যা ১০ কেজি, ইলিশ-৮ কেজি এবং টাকি মাছ ৫ কেজি। শুধু মাছের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৪ লাখ ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ খাওয়ার সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মাছ পাননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, দুপুরের খাবার মেন্যুতে ছিল পোলাও, খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট ও লটপটি। অফিশিয়াল কাগজ অনুযায়ী ভিআইপি অতিথিদের মধ্যে ছিলেন অন্য প্ল্যান্ট ও হেড অফিসের ৪০ জন এবং শিল্পীদের টিমের ১৫ জনসহ ৫৫ জন। তাহলে এসব অতিথির জন্য নিশ্চয়ই ২৭৪ কেজি মাছ অথবা এত জুস লাগেনি?
সিগারেট বিল ৩ লাখ টাকা
পিকনিক উপলক্ষ্যে আগত অতিথিদের জন্য শুধু সিগারেট কেনার বিল দেখানো হয় ৩ লাখ ৫ হাজার টাকার। বিষয়টি সবাইকে হতবাক করেছে। যেখানে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারিভাবে বিষয়টি প্রচার করা হয়, সেখানে সরকারি দপ্তরের পিকনিকে সিগারেট কেনার জন্য এভাবে বিল করা কেন বেআইনি কর্মকাণ্ড হিসাবে বিবেচিত হবে না।
বহাল ফ্যাসিস্ট সিন্ডিকেট চক্র
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বাহাদুর বেপারীর ভাই এবং শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মো. আমিনুল ইসলাম রুবেল এখনো ইডিসিএল-এর নিয়ন্ত্রক হিসাবে কাজ করছেন। যিনি আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে এ দপ্তরে টেন্ডারবাজি করে বিপুল অঙ্কের টাকা কামিয়েছেন। বিশেষ করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক শুভ্রকে ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে পুরো এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডকে পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে রেখেছিলেন।
এদিকে বর্তমান এমডি মো. এ. সামাদ মৃধা যোগদান করার পর থেকে সেই রুবেলচক্র একইভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে জিম্মি করে ফেলছে। আওয়ামী লীগ নেতা মো. আমিনুল ইসলাম রুবেল এখন ইডিসিএল-এর এমডির ভাতিজা নাজমুল হুদা, প্রোডাকশনের মহাব্যবস্থাপক মো. নজরুল ইসলাম এবং পারচেজ ম্যানেজার মো. নজরুল ইসলাম সরকারকে দরপত্র কারসাজি করে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছেন। এমনকি এই তিনজনকে আমিনুল ইসলাম রুবেল তার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স মার্ক করপোরেশন, আরকে ট্রেডার্স ও সানবিন ইন্টারন্যাশনালের অঘোষিত পার্টনার বানিয়ে একচেটিয়াভাবে ব্যবসা দিচ্ছেন এবং এর বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা কমিশন নিয়ে বিদেশে প্রাচার করে দিচ্ছেন সামাধ মৃধা। এজন্য সামাদের এ চক্র এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) সব ধরনের সরবরাহসহ নানা ধরনের কাজে নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির জিএম (প্রডাকশন) নজরুল ইসলাম গত ২৬ আগস্ট চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইনসের বিমানে ঢাকা পৌঁছান। এ সময় তিনি সঙ্গে করে ১০ কেজি ওজনের কেমিক্যাল রোল নিয়ে আসেন। অথচ এটি তার আনার কথা নয়।
ছাঁটাই বাণিজ্যের মহোৎসব
নতুন করে চাকরি বাণিজ্য করার জন্য সামাদের নির্দেশে ব্যাপকসংখ্যক কর্মীকে চাকরিচ্যুত করার পরিকল্পনা এঁটেছে এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি লিমিটেডের মাফিয়া সিন্ডিকেট। কয়েক মাস ধরেই প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে ছাঁটাই বাণিজ্যের মহোৎসব। ইডিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ. সামাদ মৃধার ছত্রছায়ায় এ পর্যন্ত্র ছাঁটাই করা হয়েছে ৭২২ জনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ভাতিজা নাজমুল হুদা এবং প্রশাসন ও মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো. মনিরুল ইসলামের মাধ্যমেই চলছে এসব অপকর্ম। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইডিসিএল-এর ঢাকা প্ল্যান্টে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১২৫ জন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পুনরায় ৩৭ জনের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পুরো আর্থিক লেনদেনটিই হয় গোপনে। এ বিষয়ে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এখন ওই বিভাগে নেই। আমি থাকাকালীন কিছুই হয়নি। যদি হয়েও থাকে, সেটি অস্থায়ীদের ক্ষেত্রে হয়েছে।
স্বজনপ্রীতি
ইডিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ. সামাদ মৃধা যোগ দেওয়ার চারদিনের মাথায় কোনো ধরনের নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে নিজ ক্ষমতাবলে ভাতিজা নাজমুল হুদাকে সিনিয়র অফিসার ও ব্যক্তিগত সহকারী হিসাবে নিয়োগ দেন। এরপর তিনদিনের মাথায় তাকে ডেপুটি ম্যানেজার হিসাবে পদোন্নতিও দেন। অথচ বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় এই নাজমুল হুদা ছিলেন প্রভাবশালী সংসদ-সদস্য নিক্সন চৌধুরীর ডান হাত। এছাড়া তিনি সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
যৌন হয়রানি
ইডিসিএলে কর্মরত এক কর্মচারী জানান, প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন নারী কর্মীর সঙ্গে ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. সামাদ মৃধার বিশেষ সখ্য গড়ে উঠেছে। এজন্য তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে কয়েকজনকে পদোন্নতি দিয়েছেন। নিয়োগের এক মাসের মধ্যে এমডি সেকশনে আনা হয় একজন সিনিয়র ক্লার্ককে। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে এমডির নির্দেশে দুটি প্রমোশন দিয়ে জুনিয়র অফিসার করা হয়। ইডিসিলের অনেকেই তাকে এমডির প্রিয়ভাজন হিসাবে জানেন। ইতোমধ্যে এই নারী কর্মকর্তার কিছু আপত্তিকর ভিডিও এখন প্রতিষ্ঠান সহকর্মীদের মোবাইল ফোনে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে আরেক নারী উৎপাদন কর্মকর্তাকে এক মাস আগে পেছনের তারিখ দেখিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়, যা নিয়ে বিতর্ক চলছে ইডিসিএল ঢাকা প্ল্যান্টে। এছাড়া এসব বিষয় নিয়ে যখন চারদিকে নিন্দা ও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে, তখন ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
দ্বৈত নাগরিক
জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এসে ইডিসিএল-এর এমডি পদে যোগ দেন মো. এ. সামাদ মৃধা। অথচ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী নাগরিক। এছাড়া জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি অকপটে প্রতিবেদককে জানান, ‘তার যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডে বাড়ি আছে। তিনি সেখানে চাকরি করতেন। বাংলাদেশি টাকায় বেতন পেতেন প্রায় ৪০ লাখ টাকা।’
উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইডিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এ. সামাদ মৃধা বলেন, ‘আমি দ্বৈত নাগরিক হতেই পারি। এতে কার কী সমস্যা? আমার ভাতিজাকে নিয়োগ দিতেই পারি, এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হলে আইনিভাবে ফেস করবো।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল