আমাদের অসৎ রাজনীতির কারণে দেশে গুম ও অপহরণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ ধরনের লোমহর্ষক অপরাধ দেশব্যাপী অহরহ ও নির্ভয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় ঘটে চলেছে। চাঁদাবাজিসহ এ ধরনের ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে সরকারের লোকদেরও যে পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে তাও দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে। সার্বিকভাবে পুলিশ অসহায় হয়ে পড়েছে। তারা এখন মৃত ব্যক্তির পরিচয় উদ্ধারে তৎপরতা দেখাচ্ছেন। ভোটারবিহীন নির্বাচিত সরকারকে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসীর পথেই ক্ষমতায় থাকতে হয়। গর্ববোধ করতে হয় নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলামকে নিয়ে, যিনি সাহস করে ফাঁস করে দিয়েছেন কে কীভাবে খুন করার জন্য ছয় কোটি টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে র্যাবের অফিসারদের দিয়েছে। তিনি র্যাবের অফিসারদের কাছে তাদের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন। ব্যাংকের টাকা নিয়ে দুর্নীতি করতেও দুর্নীতিপরায়ণদের সাহসের অভাব হচ্ছে না। কোনো মন্ত্রী বা তার আত্দীয়স্বজন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে কে কার বিচার করবে? এরপর রয়েছে পুলিশ, র্যাবসহ আরও লোকদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ। তাই বিচারের দাবির আগে সঠিক তথ্য উদ্ঘাটনের মতো শক্তিশালী তদন্ত কমিশনের দাবির গুরুত্ব বেশি বলে আমি মনে করি। সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসততা ও ধোঁকাবাজি বিরাজ করায় আস্থার স্থান নেই বললেই চলে। সমগ্র জাতির নিরাপত্তার জন্য কোথায় কীভাবে খুন ও গুমের ষড়যন্ত্র চলছে তার সমুদয় তথ্য জানতে হবে। কয়েকজনের বিচার হলেই জনজীবনে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা আসবে এমনটি বিশ্বাস করার কারণ দেখি না। যেখানে একজন প্রবীণ আইনজীবীকে জীবন দিতে হয়েছে এ জন্য যে, তিনি আইনের বিচারে সাহায্য করতেছিলেন।
এটা আদৌ ঠিক নয় যে, জনগণের বর্তমান অসহায়ত্ব ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা যারা শিক্ষিত তাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই আমরা দোষী। আমরা জনগণকে সঠিক পথে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। যার অনিবার্য পরিণতি হলো যারা জনগণের কাছেই অনুগ্রহের পাত্র ছিল তাদের কাছে জনগণ এখন অসহায়ভাবে হত্যা ও গুমের শিকার হচ্ছে। জনগণের ভোট ব্যতিরেকেই নিজেদের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ঘোষণা দিয়ে জননেতা হিসেবে তারা জনগণকেই অসহায় করে ফেলেছেন। জনগণের সম্পদ ইচ্ছেমতো লুণ্ঠন করছেন। সরকারের না আছে জনগণ প্রদত্ত বৈধতা, না আছে জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা- এ অবস্থার নাম গণতন্ত্র নয়।
সরকারের সাফল্য নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য তৈরি করে তা সত্য বলে চালাতে কিছু 'শিক্ষিত বিশেষজ্ঞের' উৎসাহের শেষ নেই। স্বৈরশাসকদের আমলেও কিছু কিছু সাফল্য থাকে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল জনস্বার্থ রক্ষায় কতটা উপকারে এসেছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। বর্তমানে দুর্নীতির দৌরাত্দ্যের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারণে এখন রাজনীতিবিদরা পুলিশ ও র্যাবের সঙ্গে মিলেমিশে খুন, গুম ও লুণ্ঠনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা মুখ থুবড়ে পড়া সত্ত্বেও একশ্রেণীর অর্থনীতিবিদের বলতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, অর্থনীতির সব সূচক উপরের দিকে এবং দেশের অর্থনীতি ভালোই চলছে। অবশ্য তারাও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি চান, কিন্তু না হলেও এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায় না। জীবনের নিরাপত্তাটুকু দিতে অপারগ সরকারকে ব্যর্থ সরকারও বলা যাবে না। লুটপাট ও অন্যান্য অবিচার করে রাষ্ট্রবিরোধী এবং গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কিছু লোক বিত্তশালী হওয়ার যে সুযোগ নিচ্ছে তা চলতে দিতে হবে।
শিক্ষিত লোকদের অংশবিশেষের সাহায্য-সহযোগিতায় জনসেবার রাজনীতির পরিবর্তে এখন রাজনীতির অর্থ দাঁড়িয়েছে জনগণকে নানাভাবে বঞ্চিত করা। শেষ পর্যন্ত জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করে জনগণের নির্বাচিত সরকার দাবি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন শাসনতন্ত্রসম্মত হয়েছে বলে দাবি করতে এক ধরনের বিশেষজ্ঞদের অসুবিধা হচ্ছে না। নিজেরা যেহেতু পাণ্ডিত্যের দাবিদার সেহেতু অন্যদের অশিক্ষিত, আহম্মক হিসেবে দেখতে পারেনই। প্রধানমন্ত্রী তাদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে খুশি হলেই হলো। শাসনতন্ত্রের ৬৫ অনুচ্ছেদে শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞরাই লিখেছেন : একেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ গঠিত হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। স্মরণযোগ্য যে, একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির অত্যুৎসাহী বিতর্কিত ও বিভক্ত রায়ের ফলে গত জানুয়ারি মাসে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই নিজেরা মিলে ভোটারবিহীন নির্বাচন করা সহজ হয়েছিল। ওই রায় অনুসরণ করে সংবিধান এমনভাবে পরিবর্তন করা হয় যাতে করে নির্বাচনী রাজনীতি চিরতরে দেশ থেকে বিদায় নেয়। নির্বাচনকালে মন্ত্রীরা মন্ত্রী থাকবেন, সংসদ সদস্যরাও সংসদ সদস্য থাকবেন। তারা এমন নির্বাচন কেন অনুষ্ঠান করবেন যাতে ক্ষমতা ত্যাগ করতে হবে? জনগণের সঙ্গে প্রতারণা একশ্রেণীর বিবেকবর্জিত শিক্ষিত লোকেরাই করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জাতিকে অভয় দিয়ে বলছেন, উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। সাতজনের গুম নিয়ে যখন চরম উত্তাপ-উত্তেজনা চলছে তার মধ্যেও অপহরণকারীরা নারায়ণগঞ্জ থেকে একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে সরকারের প্রতি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। তিন দিন পর সাতজনেরই লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের নজরদারি তাদের জীবন রক্ষা করতে পারেনি। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এত সাহস কোথা থেকে হয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জের এমপি অপহরণের ১০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও কিছু করতে পারেননি। কোনো কিছুতেই অপহৃতদের জীবন রক্ষা পায়নি। এমপি সাহেব নিজের অজান্তে নিজেই সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন। প্রহসনের নির্বাচনের পর অনেক গডফাদারের অধীনে অনেক মিনি-সরকার জন্ম নিয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করার বুদ্ধি-পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সরকারকে চালাচ্ছেন প্রাক্তন আমলা-বিশেষজ্ঞরা। তাদের বুদ্ধিমত্তায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারলেই লাভ। তা না হলে তো তাদের ক্ষমতাহীন ও গুরুত্বহীনভাবে হাঁটাচলা করে জীবনযাপন করতে হয়। এখন তারা তথাকথিত কিং মেকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অত্যন্ত ক্ষমতাধর হিসেবে আনন্দেই আছেন। ভাবছেন, বিপদ এলে আসবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপর।
সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলো, ভোটারবিহীন নির্বাচনের ফলে জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা লোপ পেয়েছে। কাজেই সরকারের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় আশা করা যায় না বললেই চলে। মোদ্দা কথা হলো, আমাদের বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণ কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আমলা-উপদেষ্টাদের ওপর নির্ভর করে শক্তি অর্জনের চেষ্টা করছেন। গুম ও হত্যার মতো কর্মকাণ্ড নিশ্চয় জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জনমনে ক্ষোভ ও বিক্ষোভেরও সৃষ্টি হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতি এভাবেই সৃষ্টি হয়।
নারায়ণগঞ্জে একজন প্রবীণ আইনজীবীসহ সাতজন অপহৃতের হত্যার পর পরিষ্কার হয়ে গেছে, দেশবাসী কেমন ভীতিকর নিরাপত্তাহীনতায় দিন যাপন করছেন এবং আমাদের বর্তমান সরকার কত বড় ব্যর্থ সরকার। অপরাধ দমনের নামে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খুন করার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। একটা প্রশিক্ষিত ও সুশৃঙ্খল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আত্দরক্ষার্থে গুলি করেছে- এমন সহজ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আইন প্রয়োগকারীরা নিজেদের জীবনের ওপর ঝুঁকি নিয়ে অপরাধীকে বিচারের সম্মুখীন করবেন। অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই কাউকে হত্যা করা আইনের চরম পরিপন্থী। পুলিশকে ফাঁসি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ডেমোক্রেসি ওয়াচ মানবাধিকার রক্ষায় খারাপ নজির স্থাপনের কারণে র্যাবকে বাতিল করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। নারায়ণগঞ্জের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী প্রকাশ্যে জানতে চেয়েছেন, গডফাদারের আর কত লাশ প্রয়োজন। অবশ্য তিনি গডফাদারের বহুবচন শব্দটি ব্যবহার করেননি।
মানবাধিকার সংস্থা ও বিশিষ্টজনরা ঘটনার ব্যাপারে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারের ওপর চরম অবিশ্বাস থাকায় তাদের দ্বারা গৃহীত কোনো পদক্ষেপই জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছে না। অপরাধীদের বিচারের নামেও যে প্রহসন হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। আমরা নিশ্চিত যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন রাজনীতিক আছেন যারা আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির কবল থেকে নিজেদের রক্ষার কথা ভাবছেন। তারা বুঝতে পারছেন প্রাক্তন আমলাদের আমলাতান্ত্রিক রাজনীতি নির্বাচনমুখী রাজনীতির কত বড় ক্ষতি করছে।
জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে যখন সমগ্র জাতি দিশাহারা, আতঙ্কগ্রস্ত, অসহায় ও ক্ষমতাহীন তখন দেশ এবং জনগণের জীবন বাঁচানোর জন্য সম্মিলিতভাবে আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে। আশার আলো দেখতে পাচ্ছি যে, দলমত নির্বিশেষে নারী-পুরুষ জোরালো, সুসংগঠিত ও জনপ্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন। সবচেয়ে বড় ভয় হলো, দেশ এক নেতৃত্বহীন নৈরাজ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রাজনীতিবিদসহ আমরা এখনো সম্মিলিতভাবে সচেতন না হলে আর কখন হব?
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।