গত ২৮ জানুয়ারি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের মতিঝিল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেছিলাম। দাবি ছিল, 'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে শান্তি স্থাপনে যার সঙ্গে প্রয়োজন আলোচনা করুন, দেশ বাঁচান। বিরোধী দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করুন, মানুষ বাঁচান।' দুজনই একসময় আমাদের শান্তির দাবিতে সাড়া দিতে বাধ্য হবেন। কারণ দীর্ঘ সময় মতিঝিলে বসে মানুষের নাড়ির খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। ঘুম থেকে উঠে কত রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা হয়েছে, রাতে দলবেঁধে শ্রমিক এসেছে, এসেছে ছাত্র-যুবক। তাদের এক কথা- সারা দেশ ঘুরে আসুন। শুধু দুই নেত্রী কেন, দেখবেন সবাই আপনার কথা শুনবে। তাই ৬৫ দিনের মাথায় ২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মতিঝিল থেকে হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজার জিয়ারতের উদ্দেশে সন্তোষে রওনা হয়েছিলাম। ১০-১২ বছরের পথশিশু কবির, রুবেল, সম্রাটরাও কয়েকজন সঙ্গী হয়েছিল। ওরা কয়েক দিন আমাদের সঙ্গেই থেকেছে, খেয়েছে, রাতে ফুটপাথে একজন আরেকজনকে বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়েছে। তারাই কান্নাকাটি করে সন্তোষে হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজার পর্যন্ত এসেছিল। অনেক বলে কয়ে সন্ধ্যায় রিফাতুল ইসলাম দীপ ও কাওসারের সঙ্গে ঢাকা পাঠিয়েছিলাম। টুঙ্গিপাড়ার পথে আবার সাথী হয়েছে। আজ আমরা পদ্মা পার হয়ে পাঁচ্চর অথবা তার আশপাশে রাত কাটাব। ইনশা আল্লাহ আগামীকাল বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত করে সেই '৯৪, '৯৫ সালের মতো কবরের পাশেই অবস্থান নেব। দীপ, কুঁড়ি, কুশি ও ওদের মা আগামীকাল আমার সঙ্গে মিলিত হবে। কুশিমণি আগেও দুবার বঙ্গবন্ধুর কবরে গেছে, দীপ, কুঁড়ি তার চেয়ে বেশি। মতিঝিলে এক জায়গায় ৬৫ দিন অবস্থানে ছিলাম। এবার ঘরে না ফিরে মাসের পর মাস রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির-মাদ্রাসায় অবস্থান নিয়ে সারা দেশ ঘুরতে চাই। যদিও কেউ কেউ অবস্থানকে শেষ পর্যন্তও প্রতীকী অনশন মনে করার চেষ্টা করেছে। কেন তা হতে যাবে? দুই বেলা খেয়ে কেন আমরা অমন প্রতীকী অনশন করতে যাব। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আল্লাহর রহমত ও জনগণের বিবেক জাগাতে ঘরের বাইরে এ অবস্থান দেশব্যাপী বয়ে বেড়ানোর সূচনায় হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজার জিয়ারতে গিয়েছিলাম। বড় ভালো লেগেছে। মাজার জিয়ারত করে পাশেই আমগাছের নিচে রাত কাটাতে তাঁবু ফেলেছিলাম। মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর কতবার সেখানে গেছি, কিন্তু ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকদের দেখিনি। তবে এবার কোনো শিক্ষক না পেলেও ছাত্রছাত্রী, এলাকার ভাইবোন, কত যে হুজুরের মুরিদ দেখেছি তার কোনো হিসাব নেই। গভীর রাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কথা বলেছে। তাদের প্রথম প্রথম পোলট্রির মুরগি বললেও তাদের সঙ্গে কথা বলে নতুন শক্তি পেয়েছি। বড় ভালো ছেলেমেয়েরা। শেষে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যশোরের রায়হান নামে এক ছেলে বর্তমান অবস্থার ওপর তার এক কবিতা শুনিয়ে সে যেমন খুশি হয়েছে আমি তার চেয়ে বেশি হয়েছি। ২ এপ্রিল হুজুরের মাজারের পাশে আসর, মাগরিব, এশা এবং ৩ তারিখ ফজরের নামাজ আদায় করে চলে এসেছিলাম। ৪ তারিখ ছিল মা'র দশম মৃত্যুবার্ষিকী। মাকে হারিয়ে কোনো বছর এমন হয়নি যে তার মৃত্যুদিনে কবর জিয়ারত করিনি। আল্লাহর অশেষ দয়ায় এবারও ছোট ভাই আজাদকে নিয়ে কবরের পাশে জোহরের নামাজ আদায় করে রসুলে করিম (সা.)-এর নামে পবিত্র মিলাদ পড়ে মিষ্টিমুখ করে সখীপুরের কালিয়ানে এক জনসভার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছি। আজ এসেছি পদ্মার পশ্চিমের শিবচরের পাঁচ্চরে। এখানকার লোকজন যে সাড়া দিয়েছে তা অতুলনীয়। ইংরেজদের তামাশার দিন ১ এপ্রিল প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে বড় বেশি তামাশা করেছে অথবা আমাদের বিদায়ে ব্যথিত হয়ে অজস্র ধারায় বারি বর্ষণ করেছে। ১ এপ্রিল ৪টায় এক সংবাদ সম্মেলন দিয়েছিলাম। বৃষ্টি এসেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সংবাদ সম্মেলন শেষে। মারাত্দক ঝড়, তুফান, বৃষ্টি। কর্মীরা প্রায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল ১ এপ্রিল রাতটা ফুটপাথে থাকতে পারব কি না। গা ঘেঁষে রেদাউনের অফিসের দরজা। একেবারে সম্ভব না হলে দরজা খুলে ফুটপাথ বরাবর শুয়ে পড়ব, তবু অন্য কোথাও যাব না। সাড়ে ১০টায় শুয়েছিলাম। তারপর ঝড়-বৃষ্টি আরও বাড়ে। কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে শেষ মুহূর্তে তাঁবু ছাড়তে হয়নি। ওপরে পলিথিন দিয়ে পানি ফেরানোর চেষ্টা হয়েছিল। সম্পূর্ণ সফল না হলেও শান্তির দূতেরা ৮০ ভাগ সফল হয়েছিল। আমাদের আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য শান্তি। সকালে যখন ঢাকা ছাড়ি তখন সালামের পাম্প থেকে তেল নিয়েছিলাম। ৬৪ দিনে লোকটির সঙ্গে একটা আত্দিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রায় সময়ই খবর নিত, ছোটখাটো সাহায্য করত। আরেকজন মির্জাপুরের মান্নান। লন্ডনপ্রবাসী জনাব ফিরোজ খানের বাড়ির কেয়ারটেকার, আমাদের নেতা-কর্মীদের গোসল করা, পেশাব-পায়খানা করা সব সময় তার বাথরুম ব্যবহার, তার নিজের রুমে প্রয়োজনে দু-তিন জনকে থাকতে দেওয়া- এসব সহযোগিতার কথা ভোলা যাবে না। বহুদিন পর টঙ্গীর রাস্তায় সন্তোষের পথ ধরেছিলাম। অবরোধ-হরতালের মধ্যেও ছিল প্রচণ্ড যানজট। সফিপুর পল্লী বিদ্যুতের পাশে চানধরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চানধরা জামে মসজিদের পাশে দুপুরের খাবারের আয়োজন ছিল। মূল উদ্যোক্তারা আলী হোসেন, শৈয়ব মাতাব্বর, ওসমান আলী, নজরুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন। আমরা ছিলাম ৩০-৩৫ জন। খাবার এসেছিল প্রায় ২৫ বাড়ি থেকে। নানা রঙের নানা স্বাদের খাবার। যারা না খেয়েছে তারা মায়ের পেটেই আছে। বড় বড় পাঁচতারা হোটেলেও অমন সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায় না। টাকি মাছের ভর্তা, কড়া পুঁটি ভাজা, দেশি গোলসা মাছের তরকারি, রাতে খাবার জন্যও নিয়ে এসেছিলাম। সন্তোষ মাজারে আগে থেকেই আবু বকর ভাসানীর ছেলে, হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নাতি হাসরত ভাসানী আমাদের খাওয়াতে নিতে চেয়েছিল। আমি না করেছিলাম। কারণ ময়মনসিংহের কাঠগোলার উজ্জ্বল এক অসাধারণ কর্মী। আজ প্রায় ১৫ বছর দলের জন্য তার ত্যাগ ও নিষ্ঠার শেষ নেই। বিয়ে করেছে দেলদুয়ারের সিলিমপুরে। তার আমাকে এক বেলা খাওয়ানোর বড় সাধ। রাতে সে অসম্ভব সুস্বাদু খাবার এনেছিল। সেখানেও টাকি মাছ, গোলসা মাছ, লাউ, ভাজি, সবজি, নানা উপাদেয় খাবার। যদিও আমি খুবই কম খাই, তবু লোকজন থাকায় খাবার নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। মুক্তিযুদ্ধে সামাদ গামা একাই আধ মণ মাংস খেত। সামাদ গামা সঙ্গে না থাকলেও তারেক, হোসেন, ডেমরার গৌতম কম যায় না, তারাও সামাদের ছোট ভাই। হাসরত ভাসানী চমৎকার খিচুড়ি রেঁধেছিল। হাসরত ভাসানীর খিচুড়ি ও উজ্জ্বলের নানা পদের তরিতরকারি। হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজারের পাশে গাছের নিচে রাতটা বেশ ভালোই কেটেছে। এ যাত্রায় হাসরত ভাসানীর সহযোগিতার কথা কখনো ভোলা যাবে না। গতকাল ছিলাম সাভার স্মৃতিসৌধের গেটে। জীবনে কত শতবার শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধে ফুলমালা দিয়েছি কিন্তু কখনো রাত কাটাইনি। এই প্রথম স্মৃতিসৌধের গেটে রাত কাটিয়ে কর্মীদের অফুরন্ত সহযোগিতা ও সাধারণ মানুষের বাঁধভাঙা অংশগ্রহণে বুকে সিংহের তেজ অনুভব করেছি। কেবল রাস্তায় বেরিয়েছি, এখনো ধাতস্থ হয়ে উঠিনি। মতিঝিলে অবস্থানে আস্তে আস্তে নাওয়া-খাওয়া, লেখালেখি কিছুটা নিয়মের মধ্যে এসে গিয়েছিল। এখন রাস্তায় বেরিয়ে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। আজ চার দিন সাবান মেখে গোসল এবং হাত-মুখে কোনো ক্রিম বা লোশন দিতে পারিনি। এটাওটা কোনোটাই খুঁজে পাই না। লিখতেও অসুবিধা। কত পাঠক অনুযোগ-অভিযোগ করছেন, তারা কেন লেখা পান না। তারা তো আর জানেন না, আমি কেমন যাযাবরের জীবনযাপন করছি।
একটানা ১০ বার বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করে সেদিন টাঙ্গাইলে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা শূন্যতা অনুভব করেছি। তাই হায়াতে কুলালে আগামী ১০ তারিখ শুক্রবার ইনশা আল্লাহ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করব। এ দেশে যে শান্তির কথাও বলা যাবে না, আগে জানা ছিল না। আমি ঠাণ্ডায় কষ্ট পাওয়া মানুষ, কতবার যে আমার তাঁবু, চৌকি-চৌকাঠ পুলিশ নিয়ে গেছে। হুজুর বলতেন মুসলিম লীগের পাণ্ডারা তার পেশাবের বদনা নিয়ে গেছে। আমার ক্ষেত্রেও অনেকটা তেমনই হয়েছে। ছালার চট দিয়ে পায়খানা বানানো হয়েছিল, সেটাও নিয়ে গিয়েছিল। মাথার উপরের কাপড় খুলে নিয়েছে। সর্বশেষ বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলাম, নামাজ শেষে ফেরার পথে শুনি বালতি, বদনা, তাঁবু সবকিছু নিয়ে গেছে। তাই মাদুর বিছিয়ে ফুটপাথে শুয়েছিলাম। সহকর্মীরা উপরে আবার পলিথিন টাঙিয়ে দিয়েছিল। সেভাবেই চলেছিল অনেক দিন। মতিঝিলের ওসি ফরমান, যার বাড়ি টুঙ্গিপাড়া। ফরমানের বাবা লায়েক আলী বিশ্বাস বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আমি যতবার টুঙ্গিপাড়া গেছি, তিনি যে কেমন করেছেন লিখে বোঝাতে পারব না। আমি থেকেছি বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে মাটিতে চাদর বিছিয়ে, তিনি সারা রাত আমার পাশে বসে, শুয়ে কাটাতেন। চাওয়ার আগেই এটাওটা এনে দিতেন। মনে হয় ফরমানের মাও খুবই ভালো মানুষ। বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন জানি না। বাড়িতে বানানো এটাওটা নিয়ে যেতেন। শত বারণ শুনতেন না। একেবারে কবরের গা ঘেঁষে পুবপাশে জননেতা আমীর হোসেন আমুর শ্বশুরবাড়ি। তারা কী যে ভালো মানুষ বলে বোঝানো যাবে না। অমন ভালো মানুষ আছে বলেই হয়তো এখনো জগৎ আছে। কিন্তু অমন হৃদয়বান সুন্দর মানুষগুলোর মাঝে ফরমান এলো কী করে? কিছু দিন যারা চোরের চেয়েও সন্তর্পণে এটাওটা নিয়ে গেছে। এমনকি আমার ৩০ বছরের সহকর্মী ব্যক্তিগত সচিবসহ কম্পিউটার অপারেটরকে নিয়ে জেলে পুরেছিল। তারাই আবার কদিন পর ছালা, চৌকি-চৌকাঠ, বাঁশ, কাঠ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়। ওরকম উত্তেজনাকর অবস্থায়ও তার অসম্ভব সৌহার্দ্যপূর্ণ কথাবার্তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। ডিসি মতিঝিল জনাব আনোয়ারের কথাবার্তা অসাধারণ। ভালো বংশের সন্তানরা যেমন আচরণ করেন, তেমনই করেছেন ডিসি আনোয়ার। কিন্তু ওসি ফরমানকে বুঝতে পারলাম না। নাকি টুঙ্গিপাড়ায় বাড়ি বলে গরম সহ্য করতে পারছেন না। যেহেতু কাল টুঙ্গিপাড়ায় যাচ্ছি, সেহেতু খবর তো নেবই। কারণ ফরমানের বড় ভাই টুঙ্গিপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান সোলায়মানকে বহু বছর ধরে চিনি। তখন ফরমান ছিল বেশ ছোট। জানি শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের উপরের নির্দেশে চলতে হয়। জনাব ফরমান যা করেছেন তা যদি উপরের নির্দেশে করে থাকেন তাহলে তাকেও ধন্যবাদ জানাব। আর যদি তা না হয়ে নিজের খামখেয়ালি বা টুঙ্গিপাড়ার গরম করে থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে ভদ্রলোককে অনেক খেসারত দিতে হবে। আমি যেমন ক্ষমায় বিশ্বাসী, তেমনি শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী তার চাইতেও বেশি।
লেখক : রাজনীতিক