রাষ্ট্রনায়কের বডি ল্যাংগুয়েজ, আত্মবিশ্বাস-কর্তৃত্ব ও আবেগিক বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করে, যা তাদের নেতৃত্বের উপস্থিতিকে শক্তিশালী করে। সাধারণ রাজনীতিবিদরা যেখানে কৃত্রিম বা অতিরিক্ত প্রস্তুতি দেখাতে পারেন, সেখানে একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক অশব্দ সংকেতের মাধ্যমে তার স্বতঃস্ফূর্ততা, মৃদু হাসি, চাহনি, বসা, গাম্ভীর্যতা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের উপর আস্থা এবং অডিয়েন্সের সাথে বিশ্বাসযোগ্যতার সংযোগ স্থাপন করেন।
শুক্রবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটের আগেই লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে পৌঁছান তারেক রহমান। টাইবিহীন, সাদা শার্টের ওপর হালকা নীল রঙের স্যুট পরা তারেক রহমান গাড়ি থেকে নামতেই তাঁকে স্বাগত জানান প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমসহ অন্য সফরসঙ্গী ও হাইকমিশনের কর্মকর্তারা। সবার সঙ্গে করমর্দন করে হোটেলের সামনে সমবেত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে হাসি মুখে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান তিনি। এ যেন শুধুমাত্র লন্ডন প্রবাসী নেতাকর্মীর উদ্দেশে নয়, দেশের কোটি কোটি বিএনপি নেতাকর্মীর উদ্দেশে। যেন এ শুভেচ্ছা দেশের প্রতিটি ইতিবাচক মানুষের উদ্দেশে।
সেদিন আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে হোটেলে প্রবেশ করেন তারেক রহমান। স্বাভাবিক, সংযত এবং নিয়ন্ত্রিত ঋজু পদক্ষেপে এগিয়ে যান মিটিং রুমের দিকে। সেখানে আগেই বৈঠক কক্ষে অপেক্ষা করছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তারেক রহমান হোটেলে প্রবেশ করতেই বৈঠক কক্ষের বাইরে এসে তারেক রহমানকে স্বাগত জানিয়ে বৈঠক কক্ষে নিয়ে যান তিনি। যা তারেক রহমানের প্রতি ড. ইউনূসের স্নেহ, ভালবাসা ও সম্মানের প্রকাশ।
দুই নেতা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় করমর্দন করেন। হ্যান্ডশেক করার সময় তারেক রহমানের হাতের উপর যে অন্য হাত রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা তা বিশাল অর্থ বহন করে। এভাবে হাত রাখার মানে হচ্ছে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, নির্ভরতা ও আস্থা। বেশ কিছু সময় তারেক রহমানের হাত মুহাম্মদ ইউনূসের দুই হাতে মুষ্টিবদ্ধ ছিল। ভালোমতো লক্ষ্য করলে স্পষ্ট, প্রথম যখন দুই নেতা হ্যান্ডশেক করেন তখন তারেক রহমানের পশ্চার ছিল, সোজা ও খোলা ভঙ্গিমায় মার্জিত হাসিপূর্ণ। তিনি কাঁধ পিছনে রেখে দাঁড়িয়েছিলেন, যাতে তাকে আত্মবিশ্বাসী এবং আন্তরিক মনে হয়েছে। যখন ড. ইউনূস দু'হাতে তারেক রহমানের হাত ধরেন, তখন তারেক রহমানের কাঁধ হালকা ঝুঁকে ছিল বিনয় ও ভদ্রতায়।
কুশল বিনিময়কালে তারেক রহমান বলেন, আম্মা আপনাকে সালাম জানিয়েছেন। যা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতির প্রকাশ, যা বাংলাদেশের কোটি কোটি মুসলমানের হৃদয় ছুঁয়েছে। দুই নেতা আসন গ্রহণ করেছেন একই সময়ে। যা দু’জনের প্রতি দু’জনার সম্মানের বার্তা বহন করে।
আবহাওয়া নিয়ে দু’জনার আলাপচারিতা শুরু হলেও, লন্ডনে হাঁটার জায়গার সুব্যবস্থার প্রসঙ্গে বগুড়ার কথা উল্লেখ করেন তারেক রহমান। ধ্যানে-জ্ঞ্যানে তারেক রহমানের মনে যে শুধুই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষ তা প্রকাশ পায়। সবার আগে বাংলাদেশ, বাংলাদেশই তারেক রহমানের প্রথম এবং শেষ।
বৈঠকে, বসা অবস্থায় তারেক রহমানের দু’হাত ছিল বিভিন্ন অবস্থায়। এর মধ্যে বেশি ছিল দু’অবস্থায়। কখনো দেখা গেছে তারেক রহমানের খোলা হাতের তালু, যা সততা ও স্বচ্ছতার ইঙ্গিত বহন করে। আবার কখনো দেখা গেছে করবন্ধন উন্মুক্ত তালু। যা সাধারণত সম্মান, সম্মতি, প্রতিশ্রুতি, একাত্মতা বা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
কথা বলার সময় তারেক রহমানের মুখের অভিব্যক্তি ছিল শান্ত ও সংযত এবং মার্জিত উষ্ণ হাসিপূর্ণ কিন্তু অতিরিক্ত নয়। ড. ইউনূসের কথা শোনার ক্ষেত্রে তারেক রহমানের সক্রিয় শ্রবণের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। তারেক রহমানের মাথা হালকাভাবে বামে ছিল। যা ড. ইউনূসের কথা মনোযোগ সহকারে শোনা ও সম্মানের প্রকাশ।
ড. ইউনূসের বাচন সুর ছিল উচ্ছ্বসিত। অন্যদিকে, তারেক রহমানের সুর ছিল স্পষ্ট নিয়ন্ত্রিত ও শ্রদ্ধাপূর্ণ । দু’জনারই পায়ের অবস্থান ছিল স্থির ও ভারসাম্যপূর্ণ। ড. ইউনূসের আই কন্টাক্ট মনে হয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু ক্লান্ত। অন্যদিকে তারেক রহমানের দৃষ্টি আন্তরিকতা ও সংযোগপূর্ণ ছিল।
বৈঠক শেষে তারেক রহমান দুই পক্ষের সকল সহযোগী সদস্যদেরকে নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে উন্নত শিরে দৃষ্টি নন্দন মৃদু হাসিতে হোটেল থেকে বের হয়ে উপস্থিত নেতাকর্মীর দিকে হাত নাড়লেন। যা দেখে মনে হল- ‘The statesman's steps began a new era of reform.’
যুগে যুগে মানুষ এ ভাবেই অবচেতনে নেতাদের শরীরী ভাষার ভিত্তিতে মুহূর্তের বিচার করে, বিশ্লেষণ করে। যা যার যার দৃষ্টিগত পার্থক্যে তা পরিবর্তনশীল। আর এভাবে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রনায়কসুলভ শরীরী ভাষার উদাহরণ। বারাক ওবামা– শিথিল কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ ভঙ্গি, পরিমিত হাতের ইশারা, দৃঢ় চোখের যোগাযোগ। অ্যাঞ্জেলা মার্কেল– তার শান্ত, স্থির ভাব এবং ‘ত্রিভুজাকার হাতের অবস্থান’-এর জন্য পরিচিত। নেলসন ম্যান্ডেলা– হাসি ও খোলা ইশারার মাধ্যমে উষ্ণতা ছড়াতেন, কিন্তু মর্যাদা বজায় রাখতেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব।