যত দিন কওমি মাদরাসায় পড়েছি তত দিন কমবেশি শিক্ষকের জুতা বহন করা এবং তাঁদের অজুর পানি এনে দেওয়া খুব কমন বিষয় ছিল। শিক্ষক জুতা হাতে হেঁটে যাচ্ছেন আর আমরা তাঁর কাছাকাছি থেকেও জুতা নিজের হাতে তুলে নিইনি—এমন হতো না। ছাত্রের উপস্থিতিতে শিক্ষক নিজের জুতা বহন করবেন আর ছাত্র খালি হাতে হেঁটে চলে যাবে এটা ছাত্রের জন্য বেমানান, অপমানজনক মনে করা হয়।
একটা কথা আছে, ‘জ্ঞান অর্জন করতে হয় শিক্ষকের পায়ের কাছে বসে।’
ছাত্র বসে আর শিক্ষক দাঁড়িয়ে বই-পুস্তক পাঠ হলেও আদব-কায়দা শেখানো যায় না। মাদরাসায় ক্লাসে শিক্ষক ছোট্ট তোশকের ওপর কিছুটা আরাম করে বসতেন আর তাঁর তিন দিক ঘিরে ছাত্ররা বসে পড়ত। গরমে ফ্যান না থাকলে পর্যায়ক্রমে ছাত্ররা শিক্ষককে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করত।
এক বছর আমি একজন শিক্ষকের খেদমত করেছিলাম। তাঁর কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করা, জুতা-সাইকেল মুছে দেওয়া, বোর্ডিং থেকে খাবার তুলে এনে দস্তরখানে পরিবেশন, খাবারের পর সেগুলো আবার ধুয়ে পরিষ্কার করা, অজুর পানি-মিসওয়াক রেডি রাখা, দোকান থেকে চা এনে দেওয়া, গরমের দিনে প্রয়োজনে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা ইত্যাদি কাজ ছিল আমার দৈনন্দিন রুটিনের অন্তর্ভুক্ত। আমি ও আমার শিক্ষক একসঙ্গে বসে খেতাম। আমার খাবারের চেয়ে তাঁর খাবারের মান কিছুটা উন্নত ছিল। তিনি ভালো খাবারের প্রায় অর্ধেকটা আমাকে দিয়ে খেতেন।
আমি বাড়ি থেকে বিভিন্ন সময় ফল নিয়ে আসতাম বা আমার ভাই দিয়ে যেতেন, সেগুলো থেকে তাঁকে খেতে দিতাম।
সে বছর আমার বোর্ড পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার আগে পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হলাম। হারিকেন জ্বালিয়ে রাত জেগে পড়তাম। পাশের রুমের ছাত্ররা শিক্ষকের কাছে তাদের ঘুমে সমস্যা হওয়ার অভিযোগ দিলে তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমার রুমের সামনে বারান্দায় পড়ো।
ঘুমে সমস্যা হলে আমার হোক, কোনো সমস্যা নেই। তিনি আমার জন্য দোয়া করতেন। পরীক্ষায় আমি বোর্ড স্ট্যান্ড করি। মেধাতালিকায় ১৪তম। সম্ভবত আমার গড় মার্ক ছিল ৯৩.৮৮। পুরো মাদরাসার সব বিভাগের সব ছাত্রের ভেতর সর্বোচ্চ নম্বরধারী হওয়ার তাওফিক আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়েছিলেন।
তিনি বাংলার শিক্ষক ছিলেন। আমলি মানুষ। এটা বলা মোটেও অত্যুক্তি হবে না যে একজন জেনারেল শিক্ষক ছাত্রদের এতটা সম্মান ও সেবা পেয়েছেন তা কেবল কওমি মাদরাসার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে।
শিক্ষকের কাছে মাথা নিচু করাতে কারো যদি ইগোতে লাগে তবে সে আর যাই হোক, আদর্শ ছাত্র হওয়ার যোগ্য নয়। কোনো মা-বাবা যদি সন্তানকে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কার্পণ্য করতে শেখান কিংবা সন্তানের কাছে শিক্ষকের স্ট্যাটাসের তুলনায় নিজেদের স্ট্যাটাস ওপরে থাকার বিষয়টি প্রমাণের চেষ্টা করেন, তবে তাঁরা আদর্শ মা-বাবা হতে ব্যর্থ এবং এর পরিণতি শিগগিরই তাঁরা দেখতে পাবেন বলে আশা করা যায়।
আমাদের জানা থাকার কথা, বাদশাহ আলমগীরের ছেলে ও তার শিক্ষকের গল্প। আমাদের কারো স্ট্যাটাস বাদশাহ আলমগীরের থেকে ওপরে নয়। তবে হ্যাঁ, শিক্ষক শিক্ষকের মতো হতে হয়। শিক্ষকতা পেশায় থাকলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। পরিমলরা শিক্ষকতার পেশায় আসতে পারেন, শিক্ষক হতে পারেন না।
কওমি মাদরাসার একটা ঐতিহ্য হলো, অনেক সময় দিনে-রাতে ছাত্ররা পড়া বোঝার জন্য হুজুরের কাছে যায়। হুজুররা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বুঝিয়ে দেন, বিরক্ত হন না। এ জন্য অতিরিক্ত কোনো মাইনেও নেন না তাঁরা।
এই যে আপনারা দেখেন, বাংলাদেশে অনেক আলেমের জানাজায় লাখ লাখ লোক হয়, কিন্তু আপনারা এর কোনো কারণ খুঁজে পান না। কারণ আপনারা বুঝতেই পারেন না, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের গুরুত্ব কতটুকু। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ক দুনিয়াবি স্বার্থের বহু ঊর্ধ্বে। সেই সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামান্য বেতন পাওয়া ছাত্ররাও মৃত্যুর খবরে ছুটে আসে, শিক্ষকের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাত কামনা করে রোনাজারি করে।
লেখক : প্রভাষক, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ