বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে ইংল্যান্ড সফর করছেন। তিনি রাজা চার্লসের কাছ থেকে সম্মানসূচক পদক গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া সফরে তিনি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ভেতর দিয়ে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী ‘নোবেলজয়ী’ হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর নোবেলপ্রাপ্তির পেছনে দুজন ব্যক্তির ভূমিকা আমার স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছিল। একজন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া, অন্যজন ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রিন্স চার্লস, বর্তমানে যিনি রাজা তৃতীয় চার্লস।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বদান্যতায় বাংলাদেশ সরকারের একজন কূটনীতিক হিসেবে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। আমি ছিলাম হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব।
২০০৫ সালে রানি এলিজাবেথ কমনওয়েলথভুক্ত দেশের কূটনীতিকদের জন্য বাকিংহাম প্যালেসে একটি গার্ডেন পার্টির আয়োজন করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৎকালীন হাইকমিশনার মোফাজ্জল করিম, ডেপুটি হাইকমিশনার ড. সাইফুল ইসলাম খান ও আমি দ্বিতীয় সচিব হিসেবে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলাম।
রাজকীয় রীতি অনুযায়ী প্রথমে রানি এলিজাবেথ, এরপর তাঁর স্বামী ফিলিপস এবং প্রিন্স চার্লস সারিবদ্ধভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনারদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করেন। তাঁদের নিজ নিজ দেশের বিষয়ে আলাপ করেন।
রানি এলিজাবেথ ও তাঁর স্বামী অনেকটা সৌজন্যতা করেই আমাদের সামনে দিয়ে গেলেন। এরপর এলেন প্রিন্স চার্লস। বাংলাদেশে তখন বন্যা চলছিল। প্রিন্স চার্লস বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে খোঁজখবর নিলেন।
বাংলাদেশের প্রতি তাঁর সমবেদনার কথা উল্লেখ করলেন।
বন্যা প্রসঙ্গ শেষ হতেই তিনি অকস্মাৎ বলে উঠলেন, What are you doing about Dr. Younus?
এ কথা শুনে আমরা তিনজনই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আসলে বুঝতেই পারিনি তিনি কোন ড. ইউনূসের কথা বলছেন? আর প্রিন্স চার্লস বাংলাদেশের কোনো একজন একক ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বলবেন, এটি তো আমাদের ধারণার মধ্যেই ছিল না। কিন্তু তাঁকে তো জিজ্ঞেস করা যায় না যে আপনি কার কথা বলছেন? আমাদের এমন ভ্যাবাচেকা অবস্থার মধ্যে তিনি বলে উঠলেন, I & Hilary are trying for Younus’s nobel prize. Your government should come forward. হিলারি ক্লিন্টনের নাম উচ্চারণ করায় আমরা বুঝতে পারলাম তিনি আজকের ড. ইউনূসের কথা বলছেন। আমাদের এই আলাপচারিতার আগে হিলারি ক্লিন্টনকে বাংলাদেশে এনে ড. ইউনূস বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।
প্রিন্স চার্লস চলে যাওয়ার পর হাইকমিশনার আমাদের দুজনের সঙ্গে আলাপ করে প্রিন্স চার্লসের এ কথার গুরুত্ব সত্বর সরকারকে জানানোর কথা বললেন। বাকিংহাম প্যালেস থেকে আমরা সোজা চলে গেলাম বাংলাদেশ হাইকমিশনে।
ডিপ্লোমেটিক প্রটোকল অনুযায়ী হাইকমিশনার বিষয়টি রিপোর্ট করবেন পররাষ্ট্রসচিবকে। আমি যেহেতু ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট ছিলাম না, আমার আবেগের জায়গা থেকে আমি হাইকমিশনারকে বললাম, আপনি বিষয়টি সরাসরি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জানান। প্রটোকল অনুযায়ী তিনি সেটিও করতে ইতস্তত বোধ করলেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছিলেন ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী। আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আমার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমি তাঁকে ফোন করে হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলাম।
ড. কামাল সিদ্দিকী বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তিনি এ বিষয়ে হাইকমিশনারকে অবহিত করবেন। সম্ভবত সেই দিন কিংবা পরদিন ড. কামাল সিদ্দিকী হাইকমিশনারকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রীকে তিনি অবহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম reaction হলো, ‘বাংলাদেশের একজন মানুষ নোবেল পাবে, এটি তো আমাদের জাতির জন্য গর্বের বিষয়। আমাদের সরকার ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করবে।’
ড. কামাল সিদ্দিকী প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে কী কথা হয়েছে তার একটি হুবহু বর্ণনা প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বরাবর পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। সেই মোতাবেক হাইকমিশনার সেটি করলেন।
আগেই বলেছি, আমি ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট না। কাজেই এর পরে কী হয়েছে, তা আমার আর জানার কথা ছিল না। আর নোবেল যেহেতু সুইডেন থেকে দেওয়া হয়, কাজেই লন্ডন মিশনের কাজের আওতায় এটি পড়ে না।
এদিকে বাকিংহাম প্যালেসের এই ঘটনার পর বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সুইডেনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বেশ পরিবর্তন ঘটে। লন্ডনস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোফাজ্জল করিম চাকরি শেষে দেশে ফিরে যান। সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাবিহ উদ্দিন আহমেদকে লন্ডনে হাইকমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়। আমি লন্ডন হাইকমিশনেই ছিলাম।
তখনো সুইডেনে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন লন্ডন হাইকমিশনে আমার সাবেক সহকর্মী, বর্তমানে রুমানিয়ার রাষ্ট্রদূত শাহনাজ গাজী।
২০০৫ সালের শেষার্ধে আমি পরিবারসহ বেড়াতে গিয়েছিলাম সুইডেনে। রাষ্ট্রদূত শাহনাজ গাজীর বাড়িতে ছিলাম। রাতে খাবার টেবিলে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, সুইডেনে তো আমাদের দূতাবাসের কাজ কম। তো আপনি কী নিয়ে ব্যস্ত থাকেন?
জবাবে তিনি যা জানালেন, আমাকে তা নিয়ে গেল বাকিংহাম প্যালেসে। তিনি বললেন, ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির বিষয়টি খালেদা জিয়া সরকারের টপ প্রায়োরিটি। আমাদের সেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ড. ইউনূসকে নিয়ে নোবেল কমিটিসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করতে হয়। ঢাকায় রিপোর্ট করতে হয়। ড. ইউনূস নিজেও সুইডেন সফর করেছেন এবং আরো করবেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে।
শাহনাজ গাজীর কথার মর্মার্থ হলো, ড. ইউনূসের নোবেলপ্রাপ্তির assignment হলো পুরো বাংলাদেশের ইজ্জতের ব্যাপার। বিষয়টি যতনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, তার চেয়ে বেশি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার।
শাহনাজ গাজীর সঙ্গে আমার আলাপচারিতা এখানেই শেষ। আমিও আর এ বিষয়ে খবর রাখিনি।
পরবর্তী সময়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন ২০০৬ সালে।
তাঁর নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়ে খালেদা জিয়া এত বেশি সিরিয়াস ছিলেন যে সুইডেনে নিযুক্ত পরবর্তী রাষ্ট্রদূত আজিজুল হক যখন সুইডেনের রাজার কাছে তাঁর পরিচয়পত্র পেশ করেন, তিনি তখন ড. ইউনূসের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণাঙ্গ সমর্থন প্রকাশ করেন এবং সুইডেনের রাজার সহযোগিতা কামনা করেন।
এভাবেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল বিজয়ী হয়ে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। কিন্তু এত বড় অর্জনের পেছনের দুজন কারিগর খালেদা জিয়া ও প্রিন্স চার্লসের ভূমিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। নিশ্চিতভাবে খালেদা জিয়া করেছেন দেশের টানে, প্রিন্স চার্লস হয়তো করেছেন বন্ধুত্বের টানে। দেশপ্রেম ও বন্ধুত্ব উভয়ই জাগরূক থাকুক।
লেখক : সাবেক দ্বিতীয় সচিব, বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন; ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল; সর্বশেষ নির্বাচিত সম্পাদক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি; নির্বাচিত সদস্য ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল।