২৪ মার্চ ২০০৯ নিয়োগ প্রাপ্তির সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই আমি জানি যে আমাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। তাই নিয়োগ প্রাপ্তির আগেই আমি আমার একজন 'গডফাদার'র কাছে যাই পরামর্শ এবং অনুমতি নিতে। আমার সেই 'গডফাদার' হলেন ইরশাদুল হক, সিএসপি। যিনি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭৫ সালে সিলেটের গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন। যার জন্য জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন তাকে ইন্দোনেশিয়ায় চাকরি নিয়ে চলে যেতে বাধ্য করেছিল। আমার প্রশ্ন শুনে তিনি আমাকে বললেন, 'অবশ্যই দায়িত্ব নেবে। প্রত্যেক সৎ, সাহসী মানুষ চ্যালেঞ্জ নিতে পিছপা হয় না।' বলেই তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এ পি জে আবদুল কালামের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করলেন, 'আমি সব সময় বিশ্বাস করি কাপুরুষ কখনো ইতিহাস রচনা করতে পারে না। ইতিহাস সৃষ্টি করে মানুষ, যাদের মধ্যে সাহস এবং প্রাজ্ঞতা আছে। সাহসিকতা একক, প্রাজ্ঞতা আসে অভিজ্ঞতা থেকে।' তিনি আরও বললেন, 'বঙ্গবন্ধুকন্যা যদি তোমাকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা চিন্তা করে থাকেন, তুমি দায়িত্ব পালন করতে পারবে, এ বিশ্বাস তিনি অর্জন করেছেন।' 'গড ফাদার' শব্দের অর্থ এ সমাজে হয়তোবা অনেকেই জানেন না। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এর প্রচলন খারাপ অর্থে। আসলে 'গড ফাদার' শব্দটি ব্যবহৃত হয়, খ্রিস্টধর্মে কোনো শিশুকে ক্রাইস্ট করার সময় গির্জায় নেওয়া হলে। শিশুর নিকটাত্দীয়রা ত্রুশ হাতে শপথ নিয়ে প্রকৃত পিতার অবর্তমানে শিশুর দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, তাই তাকে 'গডফাদার' বলা হয়। তার আরেক ভাই, আমারও আপন বড় ভাইতুল্য অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এইচ এম আবুল কাসেম ভাইও একই সিদ্ধান্ত দিলেন। তাদের দুজনের কাছে আমি তাদের আপন ছোটভাই।
ইরশাদুল হক স্যার আরও বললেন, 'তুমি অবশ্যই আমাদের আমলা বা সেনাবাহিনীর মতো দায়িত্ব পালন করবে না। কেননা আমাদের মধ্যে একদিনের সিনিয়র হলেও স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। আমাদের এবং সেনাবাহিনীর চাকরি হলো রেজিমেন্টেড অর্থাৎ কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে পরিচালিত। যদিও আমলাদের চাকরির নিয়ম-শৃঙ্খলা কিছুটা ধ্বংস হয়ে গেছে। তোমাদের মধ্যে হলো ভাই কালচার। তুমি আমলাদের মতো আচরণ করলেই সব ডাক্তার স্তরভেদে তোমার বিরুদ্ধে এক হয়ে যাবে। ন্যায়-অন্যায় বিবেচনায় আনবে না। তোমার ন্যায় ও সততাকে তারা অকারণে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে। এমনকি তুচ্ছ কারণে তোমার অপসারণ চাইতেও দ্বিধাবোধ করবে না।' ২৪ মার্চ ২০০৯ নিয়োগপত্র পেয়ে আমরা চারজন তৎকালীন মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক স্যারের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে, আশীর্বাদ নিয়ে ২৫ মার্চ সকালে দায়িত্ব নেই।
শুরু থেকেই আগের প্রশাসনের ডিনদের দুজন কিছুতেই আমাকে কাজ করতে দিচ্ছিলেন না। মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও পরবর্তী নির্বাচন না দেওয়া পর্যন্ত তারা একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সদস্য। সব কিছুতেই বাধা। ডিন নির্বাচন নিয়ে বিশাল শঙ্কা। সমাদর্শের ডিন ও একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেট না হলে সুষ্ঠুভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। শঙ্কিত বুকে ডিন নির্বাচন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে যারা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার সৈনিক ছিলেন তাদের জয়ের মাধ্যমে আমাদের বুকে এক অদম্য সৎ সাহসের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ডিনস্রা অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া, অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক শামসুল আলম এবং অধ্যাপক ইকবাল আর্সলান ও ডিন হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাহানা আখতার রহমান, অধ্যাপক হুমায়ুন সাত্তার, অধ্যাপক আলী আজগর মোড়ল, অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ ছিলেন প্রশাসনের সবচেয়ে বড় শক্তি।
'সক্ষমতা নিজের অন্তর থেকে আসে, ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ তা দিতে পারে না।' উপাচার্যের পদ আমার কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এটা দেশের রাষ্ট্রপতির পদ। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় নামের যে রাষ্ট্রটি আমাকে চালানোর দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন, আমি সারাক্ষণ শুধু উনার ছবিটা মনের মন্দিরে রেখে দৃষ্টি তার চোখে রেখে এগিয়ে যেতে চেয়েছি। লাইনচ্যুত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সঠিকভাবে চালানোই ছিল আমার একমাত্র ব্রত। সবচেয়ে বড় কথা জাতির পিতার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, যে কোনো ভুলের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে শাসন করতে পারেন বা তিরস্কার করতে পারেন। সর্বোপরি ক্ষমা করবেন না ব্যর্থ হলে। তাই উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই আমি নাক-কান-গলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ছেড়ে দেই। এমনকি বসার রুমটা পর্যন্ত আমার স্নেহাষ্পদ ছাত্র অধ্যাপক কামরুলকে ছেড়ে দেই। অনেকেই শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে ছাড়তে নিষেধ করেছিলেন, কারণ কেউ ক্ষমতা ছাড়তে চায় না, আমার পূর্ববর্তী ভিসিগণ প্রফেসর এম এ তাহির, প্রফেসর মাহমুদ হাসানও ছাড়েননি। কেউ কেউ বলেছিলেন, নাক-কান-গলা বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে দিলে আমার প্রাইভেট প্রাকটিস শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। আসলে সবই ভুল। উপাচার্যের দায়িত্ব একটা পূর্ণকালীন দায়িত্ব হিসেবেই আমি নিয়েছি।
নিজের দুর্বলতার দিকে নজর রেখে সিন্ডিকেটে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ মেডিকেল কলেজগুলোর প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটকে শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ করেছি। উদ্দেশ্য যাতে সামান্য ভুল সিদ্ধান্ত, তারা আমাকে শুধরে দিতে পারেন। উভয় কক্ষকে অসীম স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। একাডেমিক কাউন্সিল, সিন্ডিকেটের সভাপতি কিংবা উপাচার্য হিসেবে কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি। গডফাদারের উপদেশ অনুযায়ী উপাচার্য হিসেবে আমার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। যে কেউ আসতে পারতেন, দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী থেকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা এমনকি ফ্যাকাল্টি মেম্বার (সহকারী অধ্যাপক-অধ্যাপক)। অধিকাংশের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতাম। তবে সামান্য কিছু কর্মচারী-কর্মকর্তা সারাক্ষণই চাই-চাই, নাই-নাই নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
আমার কয়েকজন ছোট আপা অধ্যাপক শাহানা আখতার রহমান, অধ্যাপক শাহীন আখতার, অধ্যাপক সালেহা বেগমসহ অনেকে এবং বড় আপা অধ্যাপক নূরজাহান বেগম আমাকে অভূতপূর্ব সহযোগিতা করেছেন। আমি তাদের প্রতি স্বশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞ। সত্যিই আপনারা মহৎ। আমার একজন বড় ভাই, যিনি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক তিনি সার্বক্ষণিক আমাকে উপদেশ দিয়েছেন। আমি স্বীয় ধর্মমতে যতদিন উনি বেঁচে থাকবেন উনাকে দীক্ষাগুরুর আসনেই রাখব। আমার আজীবনের লালিত স্বপ্ন দুই আমিন স্যারের সেবা করব, জানি না স্রষ্টা কতদিন সেই সুযোগ দেবেন। তাদের পিতা-মাতা 'আমিন' শব্দটি কীভাবে রেখেছিলেন জানি না। সত্যিই উনারা বিশ্বাসী। আমার বাবা যিনি ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর মারা যান, যিনি আমাকে ডাক্তার হতে একপ্রকার বাধ্য করেছিলেন, আমি তার সেবা করা তো দূরের কথা, মৃত্যুর সময় গঙ্গাজলও দিতে পারিনি। পাশের গ্রাম থেকে পারিবারিক শ্মশানে আগুন জ্বলতে দেখেছি।
কিছুদিন আগে ডা. বিজয় সাহেবের নেতৃত্বে কিছু চিকিৎসক আমার রুমে কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন যাতে আমি শুধু বিব্রত হইনি, আমি বাকি জীবনের জন্য একটি পরম শিক্ষাগ্রহণ করেছি। সেদিনই আমি আমার প্রিয় সহকর্মী অধ্যাপক ইকবাল আর্সলানকে সাদা কাগজে দস্তখত করে পদত্যাগপত্র লেখার জন্য দিয়েছিলাম এবং ওই দিন থেকে আমি উপাচার্যের চেয়ারে আর বসিনি। পাশের মিনি কনফারেন্স রুমে বসেই কাজ করেছি। অধ্যাপক ইকবালই চিকিৎসক সমাজের নেতা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, পুরো দেশে।
প্রিয় সহকর্মী চিকিৎসকদের প্রতি আমার একটা অনুরোধ আমিত্ব পরিত্যাগ করুন। জীবনে গ্রহণ করার চেয়ে ত্যাগ করতে পারাটা মহামানবের কাজ। মহীয়সী নারী মাদার তেরেসার সেই অমোঘ বাণী ‘Give, Give and Give, Until it hurts’। রেসিডেন্ট এবং জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতি আমার অনুরোধ এই মন্ত্রটা স্মরণে এবং মননে রাখবেন। চিকিৎসা ও ব্যক্তিজীবনে তার প্রয়োগ করবেন। একজন ব্যথিত রোগীর সেবা আর ঈশ্বরের আরাধনা একই কথা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ-প্রতিষ্ঠানে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকেও সমসাময়িক বিষয়ের ওপর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আমন্ত্রণ জানান। আমার আগের উপাচার্যরা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কি-না জানি না, তবে কোথাও ক্লাস নিতে যাননি। এসব ক্লাস নেওয়ার পথে আমাকে ডা. নাসিমা, ডা. আতিক, ডা. উৎপল, অধ্যাপক দেবব্রত বণিক, অধ্যাপক আমিন ভাইসহ অনেকে অক্লান্ত সাহায্য করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা, স্বাধীন বাংলাদেশ, সর্বোপরি আমার দেশপ্রেম আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যে সাহায্য করেছিল তা সত্যিই আমার চিন্তা ও চেতনার অতীত। তবে অবশ্যই এর মূল চালিকাশক্তি ছিলেন আমার প্রো-ভিসিগণ, ট্রেজারার, রেজিস্ট্রার ও তার দফতর, ডিনস্রা, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, ফ্যাকাল্টিবর্গ, হাসপাতাল পরিচালক ও প্রকৌশল বিভাগ, হিসাব বিভাগ, পিডির কার্যালয়, ইনস্পেকশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা, প্রকটোরিয়াল বডি, এস্টেট শাখা, মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগ। সর্বশেষ আমার অফিস সহকর্মী সালাহউদ্দীন, আমিনুল, প্রশান্ত, নূর মোহাম্মদ, সিদ্দিক, মামুন, হাসেম, জহির ও মজিবরকে ধন্যবাদ; যারা সারাক্ষণ আমার অফিসটা আগলে রেখেছিলেন। আমার যাতে সুনাম ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকে ওদের সবার দৃষ্টি ছিল। আমি তাদের ও আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও নেতৃবৃন্দ, সেবিকাগণ ও সেবিকা নেতৃবৃন্দ আপনারা সবাই আমার অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি, আমার সহধর্মিণী ডা. জয়শ্রী রায়, যে পুরো সময়টা আমাকে অফুরন্ত সহায়তা দিয়েছেন, কখনো কোনো তদবির করেননি, আমার কন্যা ডা. অনিন্দিতা ও পুত্রবৎ জামাই ডা. পার্থ কখনো বঙ্গবন্ধুতে চাকরি চাই বলে স্লোগান ধরেননি। আমার ছেলে অরিন্দম, আমি কে, কি, অধ্যাপক না উপাচার্য, ডাক্তার না মোক্তার এ ব্যাপারে কোনো ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া কখনো দেখায়নি। সবাইকে ধন্যবাদ। আজ মনে পড়ে ২৫ মার্চ ২০০৯-তে সাংবাদিক বন্ধুদের আমি বলেছিলাম, '১৯৭০-৭৬ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ১৯৭৬ থেকে ২০০৯, আমার ৩৩ বছরের চিকিৎসক হিসেবে যে অর্জন, তা উপাচার্য হিসেবে আমি বিসর্জন দেব না।' আমি চেষ্টা করেছি। সফলতা বিচারের ভার আপনাদের ওপর। আমার ব্যর্থতা কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা ও সহকর্মীকে আমি সময়মতো অফিসে আনতে পারিনি। এ প্রসঙ্গে আমি আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব ড. এ পি জে আবদুল কালামের একটি ঘটনা উপস্থাপন করছি। তিনি যখন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করেন তখন অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান চেয়ারম্যান অর্থাৎ সর্বেসর্বা। আবদুল কালামকে দায়িত্ব দেওয়া হলো প্রথম স্যাটেলাইট নিক্ষেপ-যান SLV-3 মাধ্যমে মহাকাশে রোহিনীকে সংযুক্ত করার জন্য। এটি ছিল ১৯৭৩ সালে ভারত সরকারের বৃহৎ এবং উচ্চ তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ কর্মসূচি। হাজার হাজার বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ অবিরাম পরিশ্রমের ফসল SLV-3 ১০ আগস্ট ১৯৭৯ সালে নিক্ষেপণ করা হয়। দুর্ভাগ্য মহাকাশে রোহিনী স্যাটেলাইট স্টেশনটি সংযুক্ত হয়নি এবং তার পরিণতি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। ব্যর্থতার এই মিশন জানার জন্য উদগ্রীব সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য অধ্যাপক ধাওয়ান এপিজেকে নিয়ে হাজির হন। যদিও এপিজে প্রকল্প পরিচালক এবং মিশন পরিচালক। অধ্যাপক ধাওয়ান ঘোষণা করলেন, পুরো কার্যক্রমের ব্যর্থতা আমার, এপিজে বা তার কর্মী বাহিনীর নয়। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কাছে আমি ঋণী। একই কর্মসূচির সফলতা আসে এক বছরেরও কম সময়ে ১৯৮০ সালের ১৮ জুলাই। এবার তিনি এপিজেকে সব কৃতিত্ব দিয়ে সামনে বসিয়ে বললেন, আপনাদের সব প্রশ্নের জবাব দেবেন সফল বিজ্ঞানী, প্রকল্পের এবং মিশন পরিচালক এপিজে। আজকে সব ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব আমার, কৃতিত্ব সব প্রো-ভিসি, কোষাধ্যক্ষ, ডিনবৃন্দসহ আপনাদের সবার।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম যিনি ইউজিসি প্রফেসর হিসেবে কর্তব্যরত উনার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি, আমরা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব রেসিডেন্ট ছাত্ররা আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই রেসিডেন্সি কর্মসূচিকে অধিক এবং সঠিক মানসম্পন্ন রূপদানের জন্য। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের ‘How to achieve your potential’-এর চারটি মর্মকথা আমার জীবনে গাথা- ক. ২০ বছরের আগেই জীবনের এইম বা উদ্দেশ্য নিশ্চিত করা। খ. ধারাবাহিকভাবে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। গ. কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যে কোনো সমস্যাকে পরাস্ত করতে হবে। এবং ঘ. প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি এবং আত্দবিশ্বাসের মাধ্যমে নিজের কাজ সম্পাদন করতে হবে।
আমার পারিবারিক শিক্ষা হলো- ক. মানুষের ক্ষতি করো না, পারলে উপকার করবে। খ. কখনো মিথ্যা বলবে না, শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য হলে বলবে। গ. অসহায়কে সহায়তা দিও, বয়সে একদিনের বড় হলেও তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করবে। আমি এখনো মেনে চলার চেষ্টা করি। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভাগবত গীতায় উদ্ধৃত- 'ফুলকে দেখো, কি অকৃপণভাবে সুগন্ধ আর মধু দান করে, কিন্তু যখন তার কাজ শেষ হয়ে যায়, নিঃশব্দে ঝরে পড়ে যায়।' রেসিডেন্ট ও জুনিয়র শিক্ষকদের প্রতি আমার এই অনুরোধ এবং উপদেশ রোগীদের আত্দার আত্দীয় বা অতিথি মনে করে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দিয়ে যাও, দেখবে জীবন সায়াহ্নে অনেকেই মনে রাখবে। যেমন পুরান ঢাকার ডা. নন্দী এবং কলকাতার ডা. বিধান রায়। ডাক্তারের হওয়া উচিত ফুল অথবা পূজারি।
উপাচার্য থাকাকালীন আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। পুরাতন সবগুলো মেডিকেল কলেজে আমি গিয়েছি, ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। নিজেকে অনেক সমৃদ্ধ করেছি তাদের বুদ্ধি ও পরামর্শ নিয়ে। অতীতে কোনো উপাচার্য তা করেছেন বলে আমার মনে হয় না। ঢাকায় ছিলাম এমন একটি শুক্রবার নেই, যেদিন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিনি। প্রয়োজনে সকাল ১০টায় এসে ২টার পর এখান থেকে বাসায় ফিরেছি। আমার মনে পড়ে না, আমি কখনো সকাল ৮টা বাজার ১০ মিনিট পরে অফিসে এসেছি, কোনো জরুরি কাজে এমনকি রোগীর লোকজনও আমাকে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন করত। আমি সব সময় চেষ্টা করেছি তাদের টেলিফোন ধরতে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে।
২২ জানুয়ারি ২০১৫ আমি শারীরিকভাবে খুবই অসুস্থ, তার ওপর বিরোধী দলের অবরোধ। যথারীতি নিত্যদিনের মতো ভোর ৫-৩০টায় গ্রীণ লাইফে প্রাইভেট অপারেশন শেষে শ্বাসটান ও শারীরিক দুর্বলতায় এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি। আমার শুভাকাঙ্ক্ষী সহকারী চিকিৎসক সবাই আমাকে বললেন, বঙ্গবন্ধুতে না গিয়ে বাসায় চলে যান অথবা ক্লিনিকে একটু বিশ্রাম নেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, ঢাকায় ছিলাম কিন্তু অফিসে যাইনি এটা তো কখনো ঘটেনি। আমার তখন বিবেক ছাড়া আর কারও পরামর্শ গ্রহণ করার ছিল না। তাই ঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছে গেলাম। অফিসে পৌঁছার পরই কয়েকজন চিকিৎসকের একটা অন্যায় দাবির মুখোমুখি হতে হলো। প্রতি শব্দ বলতে চার/পাঁচটি করে কাশি হচ্ছিল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু তারা কেউ বলেননি, স্যার আমরা পরে একদিন কথা বলব। ট্রেজারার অধ্যাপক জুলফিকার রহমান সাহেবের নির্দেশে এবং ডেমনেস্ট্রেশনে পেসারের মাধ্যমে ইনহেলার টেনে, ছেলের স্কুল ফি দেওয়ার জন্য এই অবরোধের মধ্যে বারিধারায় তার স্কুলে ছুটব। যাওয়ার জন্য নিচে নামতেই দেখা আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এম ফরাসউদ্দিন স্যারের সঙ্গে। আমি দাঁড়িয়ে উনাকে অভ্যর্থনা জানানোর মধ্যেই একজন সাধারণ নন-মেডিকেল ব্যক্তি হয়েও উনি বুঝতে পারলেন, আমি সত্যিই অসুস্থ। আমি স্যারের একটা appointment করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম কাজী দীন মোহাম্মদ সাহেবের সঙ্গে, কিন্তু ব্যর্থ হই। স্যারকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে আতিথেয়তার ব্যবস্থা করতে আমার সহকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে যাই। কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল বিধায় বারিধারা থেকে সরাসরি বাসায় ফিরি এবং মোবাইল সাইলেন্ট করে বাসায় ঘুমাচ্ছি।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে মোবাইল খুলে দেখি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিটির পরপর দুটো মেসেজ। দ্বিতীয়টি হলো ‘Dear Professor Pran Gopal Datta, Mrs. Farashuddin joined me in wishing you steady and complete recovery. May the Almighty in His grace and mercy grant you a healthy safe and active life’। মেসেজটি নিশ্চয়ই উনি ম্যাডামের উৎকণ্ঠা আমার প্রতি উনার আশীর্বাদস্বরূপ পাঠিয়েছিলেন। কেউ বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, মেসেজগুলো পড়ার পরই আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছি বলে মনে হলো এবং সন্ধ্যায়, ভোরে যে অপারেশনগুলো করেছি সেগুলো দেখতে গ্রীণ লাইফ হাসপাতালে চলে গেলাম। গুরু ভক্তি, সৎ ব্যক্তি, নির্লোভ ব্যক্তিদের আশীর্বাদ সবচেয়ে বড় শক্তি।
আমি বিশ্বাস করি, অবিশ্বাসের এমন কোনো কারণ নেই, এমনকি আপনারা কেউ আমাকে আমার বিশ্বাস থেকে এটুকু টলাতে পারবেন না, যা হলো- 'এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এই দেশ দাঁড়াবে। মাটির উপরে মানব সম্পদ, উর্বর মাটি এবং মাটির নিচে খোদা প্রদত্ত সম্পদ এ দেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যাবে।' শুধু দরকার তারুণ্যের নির্লোভ সততা। এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করে আমার কবিগুরুর সেই গুরু বাক্যটি আজ বার বার মনে পড়ছে 'আমার বন্ধুভাগ্য ঈর্ষাযোগ্য- শক্রভাগ্য শোচনীয়।'
আমি আমার মাতৃতুল্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি উনার সার্বক্ষণিক সহায়তা এবং সমর্থনের জন্য। আমি যতবারই উনার কাছে গিয়েছি, ততবারই তিনি বলেছেন, 'চিকিৎসার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মান এবং মৌলিক গবেষণার উন্নতি করার জন্য।' আমি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক এবং বর্তমান মন্ত্রী মো. নাসিম এবং মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাকে সব কাজে হৃদয় উজাড় করে সাহায্য করেছেন।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।