১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ১৩:০৫
কলকাতার চিাঠ

পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নতুন নজির

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে নতুন নজির

ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের কামদুনির ঘটনায় যে ছয়জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, তাদের তিনজনকে ফাঁসির সাজা এবং তিনজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এটা একটা নতুন নজির।

দুজনকে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস দিয়েছেন বিচারপতি। ওই ঘটনার জন্য পুলিশ নয়জনকে গ্রেফতার করে চার্জশিট দিয়েছিল। তার মধ্যে গোপাল নস্কর পুলিশ হেফাজতেই মারা যায়। তাকেও আদালত দোষী সাব্যস্ত করেছেন। সবাই ভেবেছিলেন গুমরে ওঠা কান্না ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে যাবে। জীবন চলবে বহতা নদীর মতো উদাসীন স্রোতে। কিন্তু না। উত্তর চব্বিশপরগনার বারাসতের প্রত্যন্ত কামদুনি গ্রামের কয়েকজন আটপৌরে বাসিন্দা তা হতে দিলেন না। ধর্ষণ ও নির্যাতিতার মৃত্যুকে নিয়ে তারা যে আন্দোলন গড়ে তুললেন তা কার্যত এ দেশের সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে নজিরবিহীন। গণধর্ষণের কঠোর শাস্তি চেয়ে এবং প্রশাসনের গাছাড়া মনোভাবের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন শুধু এ রাজ্য নয়, দেশজুড়ে সাড়া ফেলে। পরিণত হয় আন্দোলনের প্রতীকে। 

নির্ভয়া কাণ্ডের মতোই প্রচার পেয়েছে কামদুনির ঘটনা এবং তার সঙ্গে জড়িত স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রাণপণ লড়াই। কী চেয়েছিলেন কামদুনির অধিবাসীরা? তারা চেয়েছিলেন সুবিচার এবং নির্ভয়ে চলাফেরা করার অধিকার। শুধু এটুকু চাওয়াই অপরাধ হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। আর তাই মাওবাদী তকমা দিয়ে কামদুনির টুম্পা কয়াল, মৌসুমী কয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাল্টা হুমকি দিয়ে কামদুনিসহ আন্দোলনরত গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানিয়ে দেয়— সাবধান, আগুন নিয়ে খেলবেন না। মা-বোনদের ইজ্জতের প্রশ্নকে এভাবে সস্তা রাজনীতির কাছে বিকিয়ে দেবেন না। 

কী ঘটেছিল কামদুনিতে? সবারই মনে আছে, ২০১৩ সালের ৮ জুন সংবাদপত্র খুলে রাজ্যের মানুষ বিভীষিকাময় খবরটি পড়ে শিউরে ওঠে। মাত্র কুড়ি বছরের এক তরুণীকে কলেজ থেকে ফেরার পথে বারাসতের কামদুনি গ্রামে কয়েকজন নরপশু ধর্ষণ করেছে। শুধু তাই নয়, সে যাতে কোনো দিন মুখ ফুটে সে কথা বলতে না পারে তাই নির্মমভাবে তাকে খুন করা হয়েছে। ঘটনার পর গ্রামের সব প্রতিবাদী মানুষ ফেটে পড়েন। অন্যদিকে অভিযুক্তরা তৃণমূল কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ বলে ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়াসও শুরু হয়ে যায়। ৮ তারিখেই অশান্ত হয়ে ওঠে কামদুনি। টুম্পা মৌসুমীসহ গ্রামের মহিলারা বেরিয়ে এসে পুলিশের সামনে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। তাদের বক্তব্য, ওই অঞ্চল দুষ্কৃতকারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। বারবার বলা সত্ত্বেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েই কি মানুষকে পুলিশের অপদার্থতার দাম চোকাতে হচ্ছে এবং হবে? তাদের আরও অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের তলায় তলায় সংযোগ রয়েছে। সেই কারণেই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। 

গ্রামবাসীর এ তীব্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন বহু সাধারণ মানুষ। মৌসুমী টুম্পাদের পাশে এসে দাঁড়ান বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ। প্রথম প্রতিবাদের সারিতে উঠে আসেন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। এলাকায় মিছিল সংগঠিত করেন মহিলারা। পথসভা এবং প্রতিবাদী অবস্থান চলতেই থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৫ জুন রাজ্য সরকার আধাসামরিক বাহিনী নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। 

অবস্থা সামাল দিতে ১৭ জুন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কামদুনি যান। তার আগে তিনি স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেসকে পাল্টা মিছিল করতে বলেছিলেন। কিন্তু সেই মিছিলে স্থানীয় কোনো মানুষ অংশ নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী কামদুনি থেকে ফেরার সময় তাকে ঘিরে ধরে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন কামদুনির অধিবাসীরা। সামান্য অনুযোগও কান পেতে শোনার দরকার আছে বলে মনে করেননি মুখ্যমন্ত্রী। সাততাড়াতাড়ি তিনি কামদুনি ছাড়েন। পাশাপাশি মৌসুমী টুম্পাদের আন্দোলনের প্রতিও বিরূপ মন্তব্য করেন। উপস্থিত পুলিশ সুপারকে বলেন, মাওবাদী তকমা দিয়ে তাদের জেলে ঢোকাতে। ওই দিনই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, অতি দ্রুত তদন্ত শেষ করা হবে। ৩০ দিনের মধ্যেই সাজা ঘোষণা করা হবে। কিন্তু আড়াই বছর পর সেই মামলার রায় হলো। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাস্তার সংস্কার হবে, মাধ্যমিক স্কুল হবে সেখানে। এখনো সেসব কিছুই হয়নি। উল্টো প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে বদলি করে দেওয়া হয়। তাছাড়াও শাসকের রক্তচক্ষু ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। ১৬ জুন থেকে কামদুনি কাণ্ডে সিআইডি তদন্ত শুরু হয়। তারা আটজনকে গ্রেফতার করে। বারাসত আদালতে ধৃতদের বিচার শুরু হলেও নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মামলা ব্যাঙ্কশাল আদালতে সরিয়ে আনা হয়। 

২০১৩ সালের আগস্ট মাসে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অসীম কুমার রায়ের নির্দেশে কামদুনি মামলা বারাসত থেকে কলকাতা নগর দায়রা আদালতে সরে আসে। কামদুনি কাণ্ডেই দেশের ইতিহাসে প্রথম কোনো রাষ্ট্রপতি নির্যাতিতার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করলেন এবং দ্রুত বিচারের ব্যাপারে তাদের আশ্বস্ত করলেন। ২০১৩-র ১৭ জুলাই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীর নেতৃত্বে কামদুনির প্রতিবাদীদের প্রতিনিধিদল রাইসানা হিলসে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। রাষ্ট্রপতি সব শুনে বলেন, ‘কী বীভৎস’। শুধু রাষ্ট্রপতি নন, দেশের সাধারণ মানুষও কামদুনি নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলনে পা মিলিয়েছিলেন। গত ২১ জুলাই ২০১৩-তে কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদী মিছিলে পা মেলান শঙ্খ ঘোষ, অপর্ণা সেন প্রমুখ শহরের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। তার আগে ১০ জুলাই মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা নবান্নে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তারা প্রখ্যাখ্যাত হন। পরে পার্ক স্ট্রিটে প্রতিবাদী সভা ও মিছিলে নেতৃত্ব দেন পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের নির্যাতিতা সুজেট।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

 

বিডি-প্রতিদিন/ ০১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/ রশিদা

সর্বশেষ খবর