৩ জুন, ২০২০ ২২:০৭

গোলাপের শহর সোফিয়া

মাসুদুল হাসান রনি

গোলাপের শহর সোফিয়া

বলকান অঞ্চলের বুলগেরিয়া একসময় কমিউনিস্ট শাসিত ছিল। বাম রাজনীতির সূত্রে বুলগেরিয়ার সাথে পরিচয়। কমিউনিস্ট ব্লকের দেশ বলেই অপরিসীম ভাললাগা ছিল। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইউরোপে এসেছিলাম বরাবরের মতন  ইউরেশিয়ার আমন্ত্রণে।  

বার্লিনে আমার নির্ধারিত শিডিউল শেষে পুরাই অবসর। ভিসার মেয়াদও মাসখানেকের মতন ছিল। দেশে থাকাবস্থায় এবার প্ল্যান করে এসেছি বার্লিনে কাজ শেষে বলকান অঞ্চলের রুমানিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও আলবেনিয়া একটা চক্কর দিব। অনেকটাই হান্ড্রেড মিটার রেসের মতন। 

কোথাও একরাত একদিন, কোথাও দুইরাত তিনদিন করে থাকবো। ঘুরে দেখবো বলকান অঞ্চলের সাবেক কমিউনিস্ট দেশগুলো।বলে রাখা ভালো, বলকান পর্বতমালার নামেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে বলকান। যদিও স্থানীয়দের কাছে এসব পর্বতমালা প্রাচীন পর্বত হিসেবে পরিচিত।

বার্লিনে ইউরেশিয়া ইনস্টিটিউটের দুইদিনের অনুস্টানমালা শেষে আমি চলে গিয়েছিলাম বেলজিয়ামের এন্টারপ্রেন শহরে। সেখানে আমার শুভাকাঙ্ক্ষী দুই বড়ভাই ওমর ফারুক ও প্রিয়জন নিপুভাই থাকেন। এ যাত্রায় ফারুক ভাইয়ের বাসায় দুইরাত থেকে ব্রাসেলস হয়ে গিয়েছিলাম হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট। 

ঝড়ের গতিতে ৪৮ ঘন্টা বুদাপেস্টের ওল্ডটাউন, নিউটাউন, বুদা ও পেস্টের অলিগলি চষে বেড়িয়ে ইউরোট্রেনে আমার পরবর্তী গন্তব্য বুলগেরিয়ায় পৌঁছাই সকালের আলো ফোটার আগেই। সোফিয়ার রেলস্টেশনের নামটি বড়ই বিদঘুটে। সেন্ট্রাল জেনেভস্কিয়া গারো সোফিয়া।

ভিতোশা পাহাড়ের কোলে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া'র অবস্থান। উঁচু নীচু ছোটবড় পাহাড় , টিলা , লেক ও নানান জাতের বৃক্ষরাজি দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ের বুক চিরে যাওয়া আঁকাবাঁকা পিচঢালা প্রশস্ত রাস্তা। মনে হয় সবুজের মাঝে সাপ শুয়ে আছে। 

দেশটির একপাশে নীলাভ শান্ত জলরাশির কৃষ্ণসাগর বুলগেরিয়ার সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপের দীর্ঘতম নদী দানিয়ুব বয়ে গেছে বুলগেরিয়ার উত্তর সীমান্ত দিয়ে। সোফিয়ায় নেমে  প্রকৃতির এমন রূপ প্রথম দেখায় যে কেউ মুগ্ধ হবেই।

স্টেশন হতে বের হয়ে লুজিয়া বুলভার্ড থেকে ট্যাক্সিতে চেপে বসি। গন্তব্য সেন্ট্রাল সোফিয়ায় আমার হোটেল রীলা। কুড়ি মিনিটের পথ পেরিয়ে আসার সময় গুগলে জেনে নেই সোফিয়া সম্পর্কে। 

গুগল জানায়, সামারে রোদ ঝলমলে আবহাওয়ায় বুলগেরিয়া ভ্রমনের জন্য পারফেক্ট সময় । জুন থেকে সেপ্টেম্বরে সারাবিশ্ব থেকে আসা কয়েক লক্ষ পর্যটকের আনাগোনায় সোফিয়া ও তার আশেপাশের শহর সরগরম থাকে। শীতকালে  প্রচন্ড ঠান্ডায় জমে যেতে হয়। তখন প্রচুর বরফ পড়ে চারিদিক সাদা আস্তরনে ঢেকে যায়।

সোফিয়ার পশ্চিম এবং কৃষ্ণ সাগরের পূর্ব অংশ পর্যন্ত গোলাপের উপত্যকা নামে পরিচিত। তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এখানকার কৃষকেরা কাজালনুক গোলাপের চাষ করে আসছেন। এই গোলাপের তৈল নির্যাস অত্যন্ত দুর্লভ। বুলগেরিয়ার অন্যতম রপ্তানি পণ্য।  বুলগেরিয়া ছাড়া অন্যকোথাও কাজালনাক গোলাপের চাষ খুব ভাল হয় না।

সকাল সাড়ে সাতটায় হোটেলের সামনে ট্যাক্সি থামতে ছুঁটে আসেন একজন মোটাসোটা সিকিউরিটি । টিপসের আশায় ট্যাক্সি হতে ল্যাগেজ নামিয়ে রিসিপশানে নিয়ে যায়। পাঁচ ইউরো টিপস পেয়ে মহাখুশি। আমি উঠেছি সেন্ট্রাল সোফিয়ার থ্রীস্টার হোটেল রীলাতে। মাত্র ৪০ ইউরোতে রুম ভাড়া। গোথিক স্থাপত্যশৈলীতে পুরানো ধাঁচের বিল্ডিং।ভেতরে কাঠের ওপর কারুকাজ করা আসবাবপত্রে বনেদীয়ানার ছাপ। 

রুমে ঢুকে শাওয়ার নিয়ে সোঁজা চলে যাই লবির পাশের ওপেন রেস্তোরাঁয়। ট্রেনে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। পেটে ক্ষুধা ছিল। তাই দ্রুত খাবার পাবার জন্য অর্ডার করি ডাবল এগপোচ, জেলি ব্রেড, কফি। এ ছিল সোফিয়ায় প্রথমদিনে আমার সকালের ব্রেকফাস্ট। 

খাওয়ার টেবিলে সিটিম্যাপ, ট্যুর গাইডবুক উল্টেপাল্টে দেখে ঠিক করে ফেলি সারাদিন কি কি দেখবো। আমার হোটেলের লোকেশানটি খুবই চমৎকার। মেট্রো, রেল, বাসস্টেশন সবকিছুই কাছাকাছি। দর্শনীয় হিস্টোরিকাল প্যালেসগুলো সব কাছে। হোটেল থেকে আট দশ মিনিটের ওয়াকিং ডিস্টেন্স।

সকাল সাড়ে আটটায় বের হয়ে যাই সেন্ট্রাল সোফিয়া। এটা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। সেন্ট্রালের চারপাশে রয়েছে বিশাল খোলা প্রান্তর। যেখানে কনসার্ট , রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।পুরো চত্বরটি পর্যটকদের আনাগোনায় গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে।

গাইডবুকে লেখা ছিল সোফিয়া বলতেই দ্য ক্যাথেড্রাল অব সেইন্ট আলেক্সান্দার নেভোস্কাই। এ শহরে অর্থডক্স খৃস্টানদের প্রধান চার্চ। রোমান স্থাপত্যশৈলীর নির্মানে চার্চটি দেখার মতন। উপরের অংশের গঠন  ভ্যাটিক্যান সিটির যে কোন চার্চের বলে ভ্রম হয়। 

চার্চের ভেতরে ঢুকে মনে হলো আমি যেন রোম বা ভ্যাটিক্যানের কোন চার্চে ঢুকে পড়েছি। চারিদিকের দেয়ালে শিশু যিশুখ্রিস্ট, মেরী, ক্রুশবিদ্ধ যীশু, দ্যা লাস্ট স্যাপারের চিত্র আঁকা। বুলগেরিয়ানদের জীবনে চার্চটির অপরিসীম প্রভাব র‍য়েছে। বুলগেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ক্যাথেড্রালটির নাম বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে। 

চার্চ থেকে বের হয়ে সেন্ট্রাল সোফিয়ার শপিংমলগুলো পাশ কাটিয়ে এলোমেলো হাঁটতে থাকি। আমার পরবর্তী দেখার বিষয় সেন্ট সোফিয়ার ভাস্কর্য। পাঁচ সাত মিনিট হেঁটে পেয়ে যাই। ব্রোঞ্জের নির্মিত এই ভাস্কর্যটিকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। উঁচুবেদীর ওপর স্হাপিত ভাস্কর্যটির দৈর্ঘ্যে ৮ দশমিক ৮ মিটার। ওজন ৫ টন। ২০০১ সালে নির্মিত ভাস্কর্যটি শহরের একটি নতুন ল্যান্ডমার্ক।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ডানায় সুর্য পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে। একটু একটু করে পশ্চিমাকাশ নীল থেকে রক্তিম হয়ে উঠছে। ঘুরতে ঘুরতে আমার শরীরজুড়েও ক্লান্তি নেমে আসে। রুমে ফেরার আগে  ন্যাশনাল থিয়েটারের সামনে চলে আসি। এটা দেখেই প্রথমদিনের সোফিয়া দর্শন শেষ করবো। 

রাজধানী সোফিয়া হাজার বছরের পুরোনো কিন্তু একে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন এটা একেবারে নতুন এবং চিরসবুজ। ন্যাশনাল থিয়েটারের সামনে যে উদ্যানটি রয়েছে সেটি আড্ডা দেবার জন্য ভীষন জনপ্রিয়। অসংখ্য মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের পাশে কিছু সময় সবুজ উদ্যানে কাটিয়ে উঠে পড়ি। 

শরীরজুড়ে সারাদিনের ক্লান্তি ভর করেছে। সন্ধ্যাবেলায় হোটেলে ফিরে আবারাও কুসুম গরম পানিতে শাওয়ার নিতে শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠে। শর্টস আর পাতলা টি-শার্টে ডিনারের জন্য প্রস্তুত হয়ে রেস্তোরাঁয় যাই। মেন্যু দেখে অর্ডার করি বুলগেরীয় খাবার। ফি চানা বা স্যারনে বেকড মাংস, জলপাই, ক্যাপসিকাম, পিয়াজে মাশরুম, গ্রীন সালাদ ও দই।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বুলগেরিয়ান খাবারে পার্শ্ববর্তী দেশ তুরস্ক, ইতালী, গ্রীক ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব খুব বেশী। তবে তাদের নিজস্ব খাবারের মধ্যে স্টাফফেড সয়াবিন , স্যারনে বেকড মাংস, কাবাব, টমেটো, বাঁধাকপি ও মরিচ দিয়ে বানানো সালাদ খুবই জনপ্রিয় আইটেম।

রাতে ডিনার শেষ করে বিছানায় যেতে নিমিষেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাই। সকালে ঘুম ভাঙলো বেলা করে। সাধারনত ট্যুরে এলে আমার ভাল ঘুম হয় না। সকালে জানালা খুলে বাহিরে তাকাতে মিস্টিরোদে চোখে পড়ে সেন্ট্রাল সোফিয়াকে ঘিরে গোলাপ ফুলের উদ্যান। 

জানালা থেকে যতদুর চোখ যায় শুধু লাল,সাদা,হলুদ, গোলাপী কত বাহারি রঙের গোলাপ ফুটে আছে। এতো গোলাপ একসাথে কখনো দেখেছি  কিনা সন্দেহ রয়েছে।  সারা সোফিয়া যেন একটা ফুলের বাগান। এতো ফুল দেখে সাত সকালে ভালোলাগায় মন ভরে যায়।

হোটেল থেকে সকাল এগারোটায় বের হয়ে পাশের এক রেস্তোরাঁয় ঢুকে ব্রেকফাস্ট সেরে নেই সেরিনকা (রুটির ভেতর পনির), বাকালভা ( মিস্টি দিয়ে তৈরি একধরনের খাজা) ও কফি দিয়ে। বাকালভা মিস্টি বলে আমার খুব প্রিয়। ওয়ারশ, ইস্তাম্বুল, বার্লিনে যখনই গিয়েছি তখন প্রচুর খাওয়া হয়েছে। সোফিয়াতে কেন বাদ যাবে? 

দেড়দিনের সোফিয়া ভ্রমন শেষে রাতের ট্রেনে ক্রোয়েশিয়া। এরপর আলবেনিয়া হয়ে প্যারিস থেকে ঢাকা ফিরে যাবার কথা। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে রুমে ফিরে দ্রুত রেডি হতে হবে। ঘোরার জন্য হাতে সময় আছে পাঁচঘন্টা। এর মাঝে যা যা দেখা যায় একনজর দেখে নিতে হবে।

প্রথমে দেখতে যাই বানিয়া বাশি মসজিদ। সেন্ট্রাল সোফিয়া হতে সামান্য দুরত্বে মসজিদের অবস্থান। ষোড়শ শতাব্দিতে নির্মিত মসজিদটিতে এখনো মানুষ নামাজ পড়ছে। বিশাল এই মাসজিদটির স্থাপত্যশৈলি অটোম্যান সাম্রাজ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। মনে করিয়ে দেয় ৫ শতক ধরে তুর্কিদের দখলে ছিল বুলগেরিয়া। মসজিদের বাহির ও ভেতরের অংশের নির্মান, সজ্জা  সবকিছুতে তুর্কী প্রভাব লক্ষ্যনীয়। 

এরপর গাইডবুকের সাহায্য নিয়ে প্লোভদিভ অ্যাম্ফিথিয়েটার দেখতে গিয়েছিলাম।  রোমানদের নির্মিত সোফিয়ায় সুন্দর একটি নির্দশন। ত্রাজান সম্রাটের সময়কালে থিয়েটারটি নির্মিত হয়েছিল। এখানে দেখার তেমন কিছু নেই। বিকেল পাঁচটার মধ্যে শপিংমল, ট্রামস্টেশন ও এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি শেষ করে রুমে ফিরে আসি। ত্রিশ মিনিট বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে হোটেল চেকআউট করি পরবর্তী গন্তব্যের জন্য।

সোফিয়ার মতন সংস্কৃতির শহর দেড়দিনে ঘুরে দেখা অসম্ভব। সময় করে কেউ যদি পূর্ব ইউরোপ ঘুর‍তে আসেন, অবশ্যই বুলগেরিয়া ঘুরে যেতে হবে। না হলে মনে হবে বিরাট কিছু মিস করে এলাম। হ্যাঁ, বুলগেরিয়ার জনগণের মধুর ব্যবহার ও আতিথিয়েতার কথা কোনদিন ভোলার নয়।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি-প্রতিদিন/সিফাত আব্দুল্লাহ

সর্বশেষ খবর