সরাসরি দুর্নীতির আশ্রয় নয়, তা সত্ত্বেও ফুটবল কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল, অনিয়ম, নীতিবহির্ভূত বিভিন্ন ধরনের লেনদেন সম্পাদনের ক্ষেত্রে ফিফার নজরদারির অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। চুন খেয়ে মুখ পুড়েছে। সরাসরি দুর্নীতির আশ্রয় না নেওয়া সত্ত্বেও কতগুলো অসংগতির জন্য ফিফা বাফুফেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে এবং শাস্তি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতের শরণাপন্ন হয়েও লাভ হয়নি।
এতে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব ফুটবল দরবারে ক্ষুণ্ন হয়েছে। বিষয়টি দেশের জন্য ছিল বিব্রতকর। অভিযুক্তরা তো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
অপেশাদার কার্যকলাপ, ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা- সবকিছু হালকাভাবে নেওয়ার অভিলাষ কখনো ভালো হয় না। ফিফা তো তার নির্দেশনা এবং নীতির বাইরে যাবে না। তারা স্বেচ্ছাচারিতা পছন্দ করে না। পছন্দ করে না তাদের গাইডলাইন এবং নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে সরকার বা কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ। নিয়মতান্ত্রিকতার বিভ্রম এবং অসংগতি থেকে ফুটবল মুক্তি পাকসবার নিশ্চয়ই মনে আছে, বাফুফে প্রায় সাত বছর ফিফার আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আটকে ছিল।
তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে গত বছর অক্টোবর মাসে নির্বাচনে নির্বাচিত কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর ক্রয়-বিক্রয় ও আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ফিফা সম্পূর্ণভাবে সেই আর্থিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে গত মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। আর্থিক হিসাবে গরমিল পেয়েছিল বলেই ফিফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সর্বশেষ অডিটে সন্তুষ্ট হওয়ায় ফিফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। বাফুফের বর্তমান কমিটির জন্য এটি একটি বড় স্বস্তি। একটি বিষয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে, তেঁতুলগাছের সব ভূত কিন্তু সব সময়ের জন্য বিদায় নেয়নি।
ফিফা বর্তমান কমিটির বিষয়ে যেমন উৎসাহ দেখাচ্ছে, তেমনি কিন্তু নজরেও রাখছে। আর তাই সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। ফিফা ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের’ বিষয়ে সব সময় অনড়। ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে এই চত্বরে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে ব্যবসা করার সুযোগ নেই। এতে বিশৃঙ্খলা এবং ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। নিজেদের মধ্যেও ঐক্য এবং আস্থার ক্ষেত্রে চিড় ধরে। তাই সুশাসনের চেতনাকে সমুন্নত রাখা ছাড়া উপায় নেই। জবাবদিহির ঊর্ধ্বে কেউ নন। সব বিষয়ে তো জনস্বার্থ জড়িত।
আমরা বিভিন্ন ফেডারেশন এবং অ্যাসোসিয়েশনের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতা, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির খবর প্রচারমাধ্যমে দেখি। কোনটি সত্যি আর কোনটি মিথ্যা জানার উপায় নেই। কিছুদিন এসব নিয়ে হৈচৈ হয়। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা বিষয়টিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁদের কথা হলো, এক পক্ষ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চায়। যা হোক, কয়েক দিন পর আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। অর্থাৎ যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন।
কখনো কখনো তদন্ত এবং অডিট রিপোর্টে অনিয়ম, স্বচ্ছতাহীনতা, এমনকি দুর্নীতির আশ্রয় বিষয়টি উঠে এসেছে। সুপারিশ অনুযায়ী তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ হলো ক্রীড়াঙ্গনে শাসকদলের দলীয় রাজনীতির দাপট। দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘পাসপোর্ট’। এই পাসপোর্টধারীরা ক্রীড়া প্রশাসনকে তোয়াক্কা করেন না। আর তাই ক্রীড়াঙ্গনে ক্রনিক অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করতে পারছে না।
ক্রীড়াঙ্গনে স্ববিরোধিতার মিছিল ক্রমেই বড় হচ্ছে। কাগজে দেখেছি, বসুন্ধরা গ্রুপের কাছে প্রশিক্ষণের জন্য মাঠ চাওয়া হয়েছে। অথচ কিছুদিন আগে বসুন্ধরার মাঠকে অনিরাপদ হিসেবে আখ্যায়িত করে মিডিয়ায় লাগাতার প্রচারণাকে ‘এনডোর্স’ কারা করেছে?
কর্তৃত্ববাদ অরাজতা, বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম দুর্নীতিকে সরাসরি উৎসাহিত করে। ক্রীড়াঙ্গনে আমরা নানা ধরনের ডিগবাজি দেখে অভ্যস্ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘পল্টি’ দেওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ক্রীড়াঙ্গন এবং মিডিয়া উভয় ক্ষেত্রেই একই অবস্থা। এখানেও রীতিমতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপরতা ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক কি সত্যি ওগুলো আগের মতো খায়? মানুষের নিজস্ব হিসাব এবং উপলব্ধি তো এখন অন্য রকম। মানুষ এখন আর অতীতকে বহন করতে চায় না। তাকাতে চাইছে সামনের দিকে।
সংগঠকদের বুঝতে হবে জবাবদিহিকে থোড়াই কেয়ার করার পরিণাম সব সময় ভয়াবহ। ফুটবলে চাটুকার ও ব্যক্তিত্বহীন কিছু লোক আছে, আগেও ছিল। তবে তুলনায়, সংখ্যায় কম। দায়িত্বশীল আচরণ সব সময় কাম্য। দায়িত্বভার নেওয়ার সময় মহা-উৎসাহ। আবার বলা হচ্ছে, কাজ করার মতো সুযোগ নেই। দায়িত্ব নেওয়ার সময়ও বিষয়টি কেন মাথায় আনা হয়নি? আধুনিক সময়ের ক্রীড়াঙ্গন হলো ‘প্রো-অ্যাক্টিভদের’ জন্য। এখানে সব সময় ‘পুশ’ করে কাজ করানোর দিন আর নেই। যাঁরা দায়িত্ব পালনে অপারগ বা উপভোগ করছেন না, তাঁদের তো নিজ থেকে সরে যাওয়া উচিত। এতে তাঁদের বারবার বিকল্প মনোভাবের সম্মুখীন হতে হবে না। সংগঠকরা তো আর ক্রীড়াঙ্গনে চাকরি করেন না।
ফুটবলে সংস্কারের দরকার আছে। কাগজে দেখেছি, কয়েকজন সংগঠক এই বিষয়ে কথা বলেছেন। মনে রাখতে হবে, সংস্কার তখনই কার্যকর হবে, যখন স্পষ্ট অঙ্গীকার থাকবে। ফুটবলে এটি মোটেই কাম্য নয় বিভিন্ন কাজে অন্যকে টপকে নিজকে গুরুত্বপূর্ণ জাহির করা। ফুটবলে যাঁরা দায়িত্বশীল, তাঁদের উচিত আরো অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কথা বলা এবং কাজ করা। কারো কারো কথাবার্তা বিভ্রান্তিমূলক। ফুটবলে ‘হুয়িমসিক্যালি’ সিদ্ধান্ত নেওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। ‘চেইন অব কমান্ড’ সবার ওপরে। ব্যবস্থাপনা সব সময় বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুণাবলিসম্পন্ন শতভাগ পেশাদার মনোভাবসম্পন্ন মানুষ প্রয়োজন! যিনি এবং যাঁরা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, যাঁরা সবাইকে সম্পৃক্ত করে কাজ করতে চান। সবাইকে বোঝার চেষ্টা করেন। ফুটবল ব্যবস্থাপনা কিন্তু এখন আর শুধু বাফুফের অফিস কক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়-মাঠে, মাঠের বাইরে সর্বক্ষেত্রে।
মানবিক ক্রীড়াঙ্গনের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হয়। এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা, যাঁরা উদ্যোগ নেবেন তাঁদের মধ্যে। সবাই চান নিয়মতান্ত্রিকতার বিভ্রম থেকে মুক্তি পাক ফুটবল। আদর্শিক অবস্থানগুলোর গুরুত্ব বাড়ুক। অসংগতিগুলো দূর হোক।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক, সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি ওআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ