২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের মূল্যায়ন করতে হবে যে ব্যতিক্রমী সময়ের প্রেক্ষাপটে বাজেটটি প্রণীত হয়েছে তাকে বিবেচনায় রেখে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে প্রণীত এই বাজেটের মূল দর্শন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার কথা, যে বাজেট একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অভীপ্সাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
বাজেটের প্রস্তাবিত কর কাঠামো, ব্যয়বিন্যাস ও উন্নয়ন কর্মসূচির অগ্রাধিকার নির্ধারণ কিভাবে করা হয়েছে, তার নিরিখেই বাজেটকে মূল্যায়ন করা সে কারণে যুক্তিসংগত হবে। সামষ্টিক অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীল হচ্ছে, কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিয়োগ চাঙ্গা করে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে বেগবান করতে এই বাজেট সক্ষম হবে কি না, এটাই বিচার্য বিষয়।
উল্লেখিত প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে জনকল্যাণে এবং বিনিয়োগ-ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ ও প্রস্তাবের প্রতিফলন থাকলেও তা বণ্টনের ন্যায্যতা এবং বিনিয়োগে চাঞ্চল্য সৃষ্টির নিরিখে অর্থনীতির বর্তমান চাহিদার মাপকাঠিতে প্রস্তাবিত বাজেট ব্যতিক্রমী হয়েছে, সেটা বলা যাবে না।
গত দুই বছরে গড় মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারের কারণে ভোগ্যপণ্যের মূল্য ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা ২০২৫-২৬ করবর্ষের জন্য অপরিবর্তিত রেখে ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষে ২৫ হাজার টাকা মাত্র বাড়ানো হয়েছে। দুই বছর আগে করমুক্ত আয়ের যে সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার ক্রয়ক্ষমতার অবনমনের নিরিখে প্রস্তাবিত আয় কর কাঠামো নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
অন্যদিকে আয়করের বিভিন্ন স্ল্যাবের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন করা হয়েছে (৫ শতাংশ স্ল্যাব বাতিলের সাপেক্ষে), তা মূল্যস্ফীতির চলমান প্রেক্ষাপটে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করবে; বিশেষত যখন মজুরি ও আয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না। যাদের বার্ষিক আয় ছয় লাখ বা ১০ লাখ টাকা, তাদের আয়কর প্রস্তাবিত করহারের ফলে আগামী দুই করবর্ষে যথাক্রমে ১২.৫ শতাংশ ও ১৬.৭ শতাংশ বাড়বে। এটা অবশ্য ইতিবাচক যে বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য করমুক্ত আয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি ছাড় দেওয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ করহার কভিডপূর্ব ৩০ শতাংশের পর্যায়ে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ২০২৫-২৬ করবর্ষ থেকেই কার্যকর হবে।
এই প্রস্তাব আয় পুনর্বণ্টনের ন্যায্যতার দিক থেকে যুক্তিযুক্ত হয়েছে। কিন্তু এসব অনেক আগেও ছিল। সম্পদ কর বা উত্তরাধিকার করের মতো ব্যতিক্রমী উদ্যোগের প্রস্তাব বাজেটে করা হয়নি।
ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশের অভিন্ন কাঠামোতে নেওয়ার জন্য আইএমএফের একটা চাপ ছিল, যার প্রতিফলন বাজেটের বিভিন্ন প্রস্তাবে দেখা যায়। বেশ কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে; অনলাইন ব্যাবসায় কমিশনের ওপর ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে; গৃহস্থালি পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এগুলো ভোক্তার ওপরই শেষ বিচারে বর্তাবে। যদিও বেশ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্কহার হ্রাস করা হয়েছে অপ্রত্যক্ষ কর কাঠামোর যৌক্তিকীকরণ ও অ্যান্টি-এক্সপোর্ট বায়াস হ্রাসের লক্ষ্যে।
বিগত সময়ে কর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা মোকাবেলা করতে গিয়ে অগ্রিম আয়কর, অগ্রিম ভ্যাট ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে। প্রচলিত এই ধারা থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বের হতে পারেনি। অনেক পণ্যে নতুন করে ২ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের ক্ষেত্রে আগাম কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে, যদিও এটাকে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বলে ধরে নেওয়া হবে বলে বলা হয়েছে। জানা কথা, পরবর্তী সময়ে প্রদেয় করের সঙ্গে অগ্রিম করের সমন্বয় করার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হয়, যদিও এবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে অগ্রিম ভ্যাটকে চূড়ান্ত হিসাবে ধরা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে সমন্বয়ের সময় বাড়ানো হয়েছে। সমস্যা হলো, এ ধরনের অগ্রিম আয়কর অনেক ব্যবসায়ী বিক্রয়কর হিসেবে বিবেচনা করেন এবং ভোক্তার ওপরে চাপিয়ে দেন। এটা আয়কর আরোপের নীতিমালা ও দর্শনের পরিপন্থী।
এটা মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশে যত পয়েন্টে ভ্যাট আদায় করা হয়, সরকারের কোষাগারে তার একটি অংশ মাত্র যোগ হয়। তিন লাখ ইএফডি মেশিন স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ সরে এলো কি না, তা-ও বোঝা গেল না। বাস্তবতার পরিবর্তন নয়, বাস্তবতা মেনে নেওয়ার দিকেই বেশি ঝোঁক দৃশ্যমান।
সামাজিক সুরক্ষা খাতের ব্যাপ্তি ও প্রাপ্তি কিছুটা বাড়ানো হয়েছে, যদিও ভাতা যা বাড়ানো হয়েছে, তা মূল্যস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে বেশ হতাশাজনক।
কর-জিডিপি হার ৮-৯ শতাংশের মধ্যে থাকলে, আর তার সঙ্গে (ঋণনির্ভর) ঘাটতি অর্থায়ন জিডিপির ৩-৪ শতাংশের বেশি না বাড়াতে চাইলে বাংলাদেশের সরকারি ব্যয় জিডিপির ১২-১৩ শতাংশের বেশি করা যাবে না। উন্নয়নশীল বিশ্ব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম সর্বনিম্ন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালে এই হার ২৪ শতাংশের বেশি। সুতরাং ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত আকারের সরকারি ব্যয় নিয়ে যে ধরনের ও মানের ব্যয়বিন্যাস হওয়ার কথা, তার থেকে বেশি প্রস্তাবিত বাজেটের কাছ থেকে প্রত্যাশা করাটা অন্যায়ই হবে। দুঃখের বিষয় হলো, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বহুদিনের এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসার পথ দেখাতে পারেনি।
লেখক : সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)