২২ অক্টোবর, ২০২২ ১১:৪২

নিরাপদ সড়ক : প্রত্যাশা ও উদ্যোগ

মো. আবু নাছের

নিরাপদ সড়ক : প্রত্যাশা ও উদ্যোগ

মো. আবু নাছের

আজ ২২ অক্টোবর, নিরাপদ সড়ক দিবস। দেশব্যাপি ষষ্ঠবারের মত দিবসটি পালিত হতে যাচ্ছে। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য আইন মেনে সড়কে চলি, নিরাপদে ঘরে ফিরি । দিবসটি দেশব্যাপি আলোচনা সভা, র‌্যালি এবং নানান সচেতনতাবৃদ্ধিমূলক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোও দিবসটি পালন করছে। 

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্বব্যাপী একটি অন্যতম প্রধান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা। যদিও সকল দেশেই কম-বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তথাপি দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরার প্রচেষ্টাও চলছে অবিরাম। তবুও সড়ক-মহাসড়কে ঘটছে মূল্যবান প্রাণহানির ঘটনা। এ প্রাণহানি অত্যন্ত বেদনার। সড়ক দুর্ঘটনায় যিনি মৃত্যুবরণ করেন তাঁর পরিবারকে দীর্ঘকাল ধরে বয়ে বেড়াতে হয় দুঃসহ যন্ত্রণা। আর যাঁরা প্রাণে বেঁচে যান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে, তাঁদের জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ। বেঁচেও তাঁরা ভোগ করেন মৃত্যুসম যন্ত্রণা। কর্মশক্তি হারিয়ে পরিবার ও সমাজের জন্য হয়ে যান বোঝা। তাই নিরাপদ সড়কের দাবি যেমনি দিন দিন জোরালো হচ্ছে তেমনি এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারি-বেসরকারি প্রয়াসও হচ্ছে শক্তিশালী। 

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার। এ লক্ষ্যে নানামূখি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। আশার কথা হলো, নানান প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস এবং অংশিজনদের সহযোগিতায় মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমে এলেও আঞ্চলিক, জেলা, উপজেলা এবং গ্রামীণ সড়কগুলোতে দুর্ঘটনা ঘটছে। বড় গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ তুলনামূলকভাবে কমলেও ছোট গাড়ি বিশেষ করে সিএনজি অটোরিক্সা এবং মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে। ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ কার্যকর করা হয়েছে। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের কাজও শেষপ্রান্তে। প্রতিপালন করা হচ্ছে সড়ক নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা। নিরাপদ সড়ক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি, সড়ক পরিবহণ উপদেষ্টা পরিষদ এবং জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া কাউন্সিল অনুমোদিত একশ এগারটি সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে কাজ করছে একটি টাস্কফোর্স। 

দুর্ঘটনার জন্য অনেক সময় সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ-ত্রুটিকে দায়ি করা হয়। ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি দেশব্যাপী বিভিন্ন মহাসড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ বাঁক চিহ্নিত করে এসব বাঁকের ঝুঁকি প্রবণতা হ্রাস করা হয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সাইন-সিগনাল ও রোড মার্কিং স্থাপন, বাস-বে নির্মাণসহ ঝুঁকিপূর্ণ করিডোর উন্নয়নে গ্রহণ করা হয়েছে বিশেষ প্রকল্প। সড়ক-মহাসড়কের স্থায়িত্ব রক্ষায় অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে দেশব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে আটাশটি ওজন স্কেল স্থাপন করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি সড়কের পাশে যত্রতত্র বাস থামানো বন্ধে পরিকল্পিত বাস স্টপেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। অপরিকল্পিত গতিরোধক অপসারণ করা হয়েছে। আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও চালু করা হয়েছে রোড সেফটি অডিট।  

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে যানবাহনের ক্রমবর্ধমান চাপ বেড়ে যাওয়ায় সরকার মহাসড়কসমূহ পর্যায়ক্রমে চার বা ততোধিক লেনে উন্নীতকরার কাজ করছে। মহাসড়কে বিভাজক স্থাপনের ফলে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মহাসড়কে ছোট আকারের যানবাহন দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে, তাই সরকার বাইশটি জাতীয় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চলাচল নিষিদ্ধ করে। এতে সুফল মিলেছে। পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তায় হাইওয়ে পুলিশ গঠন এবং এর জনবল বাড়ানো হয়েছে। তবে সড়ক নিরাপত্তায় হাইওয়ে পুলিশের লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো সময়ের দাবী। পেশাদার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের সময় ডোপটেস্টের পাশাপাশি গাড়িচালকদের লাইসেন্স নবায়নে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নারী গাড়িচালক তৈরির সুযোগও বাড়ানো হয়েছে। এরই মাঝে অধিকসংখ্যক মোটর ড্রাইভিং স্কুলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে মোটরযানের ফিটনেস সনদ দেয়া হচ্ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে বিআরটিএর পরিবহন সেবায় এসেছে পরিবর্তন। গ্রাহকরা অনেক সেবা এখন অনলাইনে ঘরে বসে বিনাভোগান্তিতে পাচ্ছেন। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার জন্য সড়ক ব্যবহারকারীদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সড়ক নিরাপত্তায় পথচারি তথা সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজের নিরাপত্তায় যানবাহন চালানো অবস্থায় সিটবেল্ট বাঁধা এবং চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। মোটর সাইকেল চালক ও আরোহীকে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে। 

সম্প্রতি পরিবহনে নারীদের হয়রানি এবং তাদের প্রতি অশ্লীল আচরণের বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসছে। যদিও হয়রানির একটি নগণ্য অংশই পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায়। পরিবহনখাতে শৃঙ্খলার পাশাপাশি নারীর মযাদা ও নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহাসড়কে অনেক অর্থব্যয় করে নির্মিত ফুটওভার ব্রীজগুলোর যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। ঝুঁকি নিয়ে ফুটওভারের নীচ দিয়ে পার হচ্ছে অনেকেই। আবার দেখা যায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ডিভাইডারের বেড়ার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে রাস্তা পার হতে। জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতে চাননা। আবার কেউ কেউ রাস্তা পার হওয়ার সময় মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। একটি মোটর সাইকেলে বাচ্চাসহ পুরো পরিবার নিয়ে দুরপাল্লায় ভ্রমণ করছি অনেকে। ট্রাফিক আইনের প্রতি এ ধরণের উদাসীনতা জীবনঘাতি দুর্ঘটনায় রূপ নিতে পারে। তাই এ সকল বিষয়ে আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক সংগঠনগুলো জনসচেতনতা তৈরিতে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে। 

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রকৌশলগত ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি আইনের বাস্তবায়ন এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা এ তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এ বাস্তবতায় জনসচেতনতা তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ সমন্বিতভাবে কাজ করছে। এ কাজ আরো জোরদার করা জরুরি। এছাড়া একক কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা নয়, সড়ক নিরাপদ করতে সকল অংশীজন একসাথে কাজ করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই সড়ক ব্যবহারকারি। তাই আসুন, নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলি; তবেই পূরণ হবে আমাদের নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশা। 

লেখক: উপসচিব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ
[email protected]

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন  

সর্বশেষ খবর