কথাটা রূঢ় শোনালেও বলতেই হয়, ঢাকা শহরে আজকাল ভিক্ষুকের উপদ্রব অনেক বেড়ে গেছে। রাস্তাঘাটে, হাটবাজারে তো বটেই, এমনকি পাড়া-মহল্লায়ও হাজির হচ্ছে তারা।
আমাদের ছেলেবেলা পঞ্চাশের দশকে উত্তরবঙ্গের এক জেলা শহরে শুধু শুক্রবারে অর্থাৎ জুমাবারে, দেখতাম ভিক্ষুকরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে লোকের বাসায় গিয়ে ভিখ মাগত। তাদের কেউ কেউ, বিশেষ করে অন্ধ ভিক্ষুকরা, সুর করে গান করত আর ভিক্ষা চাইত।
সেই সব অন্ধজনের সঙ্গে থাকত একজন চক্ষুষ্মান পুরুষ, যে ছিল তার দেহরক্ষী-কাম-গাইড ও ‘ক্যাশিয়ার’। মেয়ে ভিক্ষুকরাও দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়াত, তবে তাদের মধ্যে কোনো অন্ধ মহিলা ছিল বলে মনে পড়ে না। তা রাস্তাঘাটেই হোক আর পাড়ান শহরটি যে ভিক্ষুকদের জন্য ‘আউট অব বাউন্ডস’ ছিল তা নয়।
আসলে তখন সারা পূর্ববঙ্গের লোকসংখ্যাই ছিল কত? এই ধরুন, ছয় কোটি-সাড়ে ছয় কোটি। আর বগুড়া, পাবনা, রংপুর বা দিনাজপুরের মতো শহরে ২০-২৫ হাজারের বেশি লোক বাস করত কি না সন্দেহ। সেখানে ভিক্ষুক তার ভিক্ষাবৃত্তির জন্য শুক্রবারকেই নির্দিষ্ট করে রেখেছিল। আর তা-ও রাস্তাঘাটে নয়, পাড়া-মহল্লায় দ্বারে দ্বারে গিয়ে আল্লাহ-রসুলের নাম নিয়ে গৃহবাসীদের আহবান জানাত দান করে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য।
দাতা বা দাত্রী সেই উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে সচরাচর যা দান করতেন, তা টাকা-পয়সা নয়—এক মুঠো চাল, যার বাজারমূল্য বলতে কিছুই ছিল না। তখন উত্তরবঙ্গে এক মণ (৩৭.৫ কেজি) চালের দাম ছিল ৮-১০ টাকা বা তারও কম। অবিশ্বাস্য। সে যা-ই হোক, সেই আমলে ভিক্ষা চাওয়ার সিস্টেমটা উল্লেখ করলাম এই কারণে, যাতে হাল আমলের অপেক্ষাকৃত তরুণ পাঠক-পাঠিকা আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে শহরের রাস্তাঘাট কেমন ভিক্ষুকের উপদ্রবমুক্ত ছিল, তা বোঝানোর জন্য। আসলে সেই আমলে দেশের মোট জনসংখ্যা যেমন আজকের তুলনায় ছিল অর্ধেকেরও কম, তেমনি ফকির-মিসকিনও ছিল কম।
এখন রাস্তায় লালবাতি জ্বলতে দেখে আপনার ড্রাইভার গাড়ি থামানোর সঙ্গে সঙ্গে আতুর-ল্যাংড়া-অন্ধ, এমনকি সুস্থদেহী ভিক্ষুকরা, শিশু-কিশোররা এসে গাড়ির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেই আমলে এত গাড়িও ছিল না, ভিক্ষুকের ভিড়ও ছিল না মোটেই। দিন যত গড়িয়েছে, দেশের লোকসংখ্যাও তত বেড়েছে। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাটে, লোকালয়ে সবখানে ভিক্ষুকের সংখ্যাও বেড়েছে হু হু করে। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। সংগত কারণেই গর্ব করি শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি, গড় আয়ু বৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা দুই-তিন দশক আগে যা ছিল, এখন মাশাল্লাহ তার চেয়ে ম্যালা কম। তেমনি আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে শিক্ষিতের হার যা ছিল, এখন তা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। এসবই দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ঠেলে তুলছে। আমাদের বিদেশি বন্ধুরা এবং দোতাগোষ্ঠী এসব দেখে পিঠ চাপড়িয়ে দেয় আমাদের। আমরা তখন একটা উচ্চাঙ্গের হাসি দিয়ে ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের ভূমিকায় অভিনয় করি। কিন্তু সচিবালয় থেকে বেরিয়ে সেই বিদেশি মেহমান সোনারগাঁও, ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা র্যাডিসন যাওয়ার পথে রাস্তায় যে বারবার ভিক্ষুকদের প্রসারিত হস্ত দ্বারা আক্রান্ত হন, তার হিসাব মেলাবেন কিভাবে? আমরা মনে করি, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প কিংবা মেট্রো রেল দেখিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেব। হয়তো তা হতেও পারে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তারা হাড়-জিরজিরে কঙ্কালসার মূর্তিগুলোকে দেখবে তাদের গাড়ির গতি রোধ করে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তখন তাদের মনে ধন্দ লাগবে : তাহলে এটাই কি আসল বাংলাদেশ?
গত ৫০ বছরে দেশ যথেষ্ট এগিয়েছে, এটা অস্বীকার করলে সত্যের অপলাপ হবে সন্দেহ নেই। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচক অন্তত তা-ই বলে। কিন্তু সেই উন্নয়ন কি সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে সমানভাবে স্পর্শ করেছে? নিশ্চয়ই না। যদি করত, তাহলে গত বছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে এত বড় বৈষম্যবিরোধী সফল আন্দোলন হতো না। তুমি খাবে কোরমা-পোলাও-কোপ্তা, আর আমার পাতে সামান্য ডাল-ভাতও পড়বে না, তুমি শোবে শাদ্দাদের বেহেশতের মতো হর্ম্যোপরি, আর আমার শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস কাটবে ফুটপাতে, এ জন্যই কি একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল? স্বাধীনতার পর দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী ধরে এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে এ দেশের ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’। জবাব পায়নি। ফলে আমাদের চোখের সামনে বেড়েছে বঞ্চিত মানুষের সংখ্যা। গ্রামের একদা সম্পন্ন গৃহস্থ আণ্ডাগণ্ডাসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে পাড়ি দিয়েছে শহরে, সেখানে বাড়িয়েছে ছিন্নমূল নিরন্ন নিরাশ্রয় মানুষের সংখ্যা। ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে বিরক্তি বাড়িয়েছে আমার, আপনার মতো শহরের সৌভাগ্যের বরপুত্রদের।
বক্তৃতায়-বিবৃতিতে, সভা-সেমিনারে এদের নিয়ে কথার তুবড়ি ফোটানোর শেষ নেই। কেউ যদি বলে এটা সুবিধাভোগীদের কুম্ভীরাশ্রু, লোক-দেখানো মায়াকান্না, তাহলে কি খুব একটা ভুল হবে? নিশ্চয়ই না। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা, বুদ্ধিজীবীমহল দরিদ্র অসহায় মানুষদের নিয়ে কথার তুবড়ি ফোটাতে যতটা ওস্তাদ তার সিকি ভাগও যদি তাঁরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে বঞ্চিত সহায়-সম্বলহীন মানুষদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য ব্যয় করতেন, তাহলে গত ৫০ বছরে এ দেশের চেহারায় অনেক খোলতাই লক্ষ করা যেত। রাস্তায় বড়লোকদের গাড়ি থামলেই ভিক্ষুক শ্রেণির মানুষদের পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যেত না।
অথচ বিগত অর্ধশতাব্দীজুড়ে নেতা-পাতি নেতাদের মুখে কত বড় বড় বুলি শোনা গেছে দেশের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যাপারে। কখনো ভোটের ময়দানে, কখনো আঁতেলদের সভা-সমিতিতে। কিন্তু কেউই দেশের অগণিত গরিব-গুবরো, ফকির-মিসকিনদের টেনে তোলার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট প্রকল্প—তা স্বল্প, মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদি যা-ই হোক—গ্রহণ করেননি। তাঁরা সব সময় বিশ্বাস করেছেন, তেলা মাথায় তেল দিলে সামান্য হলেও কিছুটা তেল চুইয়ে চুইয়ে পড়বে চিবুক বেয়ে। আর দেশের নিচতলার মানুষ ওটাই চেটেপুটে খেয়ে মোটাতাজা হবে। কিন্তু এই ‘ট্রিকল ডাউন ইফেক্ট’-এর ধারণা যে কয়েক যুগ আগেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তা তাঁরা বুঝতে চাননি। এর বিপরীতে ‘টার্গেট স্পেসিফিক’ অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়ে ভিক্ষুক শ্রেণির মানুষগুলোর ভাগ্যের চাকা ঘোরানো যেত ‘স্লোলি বাট স্টেডিলি’। ভিক্ষুক শ্রেণির কর্মহীন মানুষগুলোকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভিক্ষুকের হাতকে করা যেত কর্মীর হাত। কিন্তু সে চেষ্টা কেউই করেনি। করবে কী করে, সবাই তো ব্যস্ত ছিল নিজেদের আখের গোছাতে। সেই যে ইংরেজি প্রবাদবাক্য আছে না, ‘মেইক হে হোয়াইল দ্য সান শাইনস’—সূর্যের তাপ থাকতে থাকতে (ধানের আঁটি/গমের আঁটি শুকিয়ে) খড় বানিয়ে নাও। বেশির ভাগ নেতা-নেত্রী চলেছেন ওই পথে, আর তাঁদের চ্যালা-চামুণ্ডারাও তাঁদের দেখানো পথে চলে কেউ হয়েছে আঙুল ফুলে কলাগাছ, কেউ তালগাছ, কেউ বটগাছ।
১৫-১৬ বছরের দুঃস্বপ্নের কাল কেটে দিগন্তে উদিত হয়েছে এক নতুন সূর্য। তারই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আমরা বিশ্বাস করি দেশ চলবে ন্যায়-নীতি-সাম্যের পথে, চির ভাস্বর গণতন্ত্রের পথে। ১৭-১৮ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের গণতন্ত্র আসবে দেশে, সমাজের নিচতলার চির অবহেলিত, চির বঞ্চিত মানুষগুলোর ভিক্ষুকের হাত হবে কর্মীর হাত। ভিক্ষুক বলে আর কাউকে অপমানিত-নিগৃহীত হতে হবে না এই স্বপ্নের দেশে।
শেষ করার আগে আজকের লেখার শিরোনাম নিয়ে দুটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক হবে মনে করি। এটি বলতে পারেন একটি ধার করা শিরোনাম। প্রবীণ পাঠক-পাঠিকাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করার লক্ষ্যে ‘গরিবি হটাও’ স্লোগান দিয়ে বেশ কিছু কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন। তবে তাঁর সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি আশানুরূপ ফল লাভ করতে পারেননি। এদিকে বিরোধী রাজনীতিবিদরা চাউর করতে শুরু করলেন : আরে এটা গরিবি হটাও না, গরিব হটাও আন্দোলন। ইন্দিরা আর তাঁর কংগ্রেস পার্টি দেশ থেকে গরিব-গুবরোকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার জন্য এই প্রোগ্রাম নিয়েছে।
বাংলাদেশেও সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো আন্দোলন বা কর্মকাণ্ড শুরু হলে তার বিরুদ্ধাচরণ কেউ করলেও করতে পারে। কিন্তু সেই সম্ভাবনার কথা ভেবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। উদ্দেশ্য মহৎ হলে তো অবশ্যই কাজ করতে হবে। ঠিক কি না?
ছোটগল্পের সংজ্ঞায় সেই যে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’-এর কথা বলেছেন না কবিগুরু, আজকের এই লেখাটিও সেই ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’-এর ফাঁদে পড়েছে দেখছি।
শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণের মহৌষধের কথাই তো বলা হয়নি। সেটি কী? সেটি আর কিছু নয়, ইসলামের ‘জাকাত’ প্রদান ব্যবস্থা। এটি কোনো মুসলিম দেশে যথাযথভাবে চালু হলে সে দেশে দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে বাধ্য। তবে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে দেশের সরকারকে। সরকার শুধু হজব্যবস্থা ঠিকঠাকমতো পরিচালনা এবং নিজেদের পছন্দমতো কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদান দেওয়ার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় নামক একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়কে কর্মহীন করে রাখার মানে হয় না। ওই মন্ত্রণালয়েই ‘জাকাত অধিদপ্তর’ নামে একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি