রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে খাল খনন কর্মসূচি চালু করেছিলেন। লক্ষ্য ছিল বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ধরে রাখা এবং শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজে সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশের মডেল তৈরি করা, যাকে ‘জিয়া মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কর্মসূচিটি কাজের বিনিময়ে খাদ্যের (কাবিখা) মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। এতে স্থানীয় জনগণ সরাসরি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে সহানুভূতি, আন্তরিকতা ও অংশগ্রহণের মনোভাব বৃদ্ধি পায়; বর্তমানে যেটিকে আমরা সায়েন্স এবং কমিউনিটি-বেইসড মডেল হিসেবে ব্যাখ্যা করি।
বর্তমানে আমাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের জিওস্প্যাশিয়াল প্রযুক্তি রয়েছে। তাই আমরা বিভিন্ন চলক (variable) মডেলে রান করে ফলাফল সম্পর্কে অনুমান করতে পারি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ওই সময় এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমন্বিত মডেলের ধারণা কোনো ধরনের প্রযুক্তি ছাড়াই দিয়েছিলেন।
একাডেমিক ফিল্ডে আমরা যখন নিষ্কাশনব্যবস্থার মডেল; যেমন—ডেনড্রাইটিক, ট্রেলিস, রেডিয়াল বা আয়তক্ষেত্রাকার নিয়ে আলোচনা করি, তখন জিয়া মডেল একটি সফল উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে উঠে আসে।
খাল খনন কর্মসূচিটি চলমান থাকলে বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রতিবছর যে বন্যা দেখা যাচ্ছে এবং শীতকালে বিভিন্ন অঞ্চলে পানির অপর্যাপ্ততা তৈরি হচ্ছে, তা এতটা প্রকট হতো না।
খাল খনন কর্মসূচি ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দেড় বছরের (সম্ভবত ১৯৭৯-১৯৮০) মধ্যে এক হাজার ৫০০টির বেশি খাল খনন ও পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল, যা সেচব্যবস্থার উন্নয়ন ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছিল। বিআইআইএসএস জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৭৯-১৯৮১ সালের মধ্যে মোট ২৭৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার ৬৩৬ মাইল খাল খনন করা হয়।
রিসার্চগেটের একটি দলিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে খাল খনন কর্মসূচির ফলে ১৯৮০ সালে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
ডিটিআইসির তথ্য অনুযায়ী, এই কর্মসূচি গ্রামীণ স্বনির্ভরতা বাড়াতে সহায়ক ছিল। এতে বিভিন্ন এলাকার মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল এবং কৃষি বিপ্লবের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ দৃঢ় করে।
তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এই কর্মসূচিটি বন্ধ হয়ে যায়। যদি এটি অব্যাহত থাকত, তবে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়নে এটি বড় ভূমিকা রাখতে পারত।
তাই বর্তমান সরকারের উচিত হবে এই কর্মসূচি পুনরায় চালু করা। আমরা আশা করব, ভবিষ্যৎ সরকারগুলোও এটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের কর্মপরিকল্পনায় খাল খনন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করবে। এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের চরম ক্ষতি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে ফেনীর বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার একটি প্রধান কারণ সেখানকার নিষ্কাশনব্যবস্থার ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এ ছাড়া দেশের বরেন্দ্র অঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলেও এর প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
২.
উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলের খালগুলো শীতকালে সেচের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর ছিল। বর্তমানে সেখানে পানির অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে। আবার বর্ষাকালে বারবার বন্যা দেখা দিচ্ছে। যদি খালগুলো জীবিত রাখা যেত, তবে এই সংকট এতটা তীব্র হতো না। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে শীতকালে সাধারণ মানুষ পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। অনেকে বাধ্য হয়ে সাবমার্সিবল পাম্প ব্যবহার করছে। যারা তা করতে পারছে না, তারা বাজার থেকে পানি কিনে ব্যবহার করছে। এতে পরিবারগুলোর আর্থিক চাপ বাড়ছে। যদি খালগুলো রক্ষিত থাকত, তবে ভূগর্ভস্থ পানি পুনর্নবায়ন হতো এবং সহজেই পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহার করা যেত।
মধ্যাঞ্চলের নদী, খাল ও প্লাবনভূমি অতিরিক্ত বর্ষার পানি দ্রুত নিষ্কাশনে সাহায্য করত। একই সঙ্গে শীতকালে পানি ধরে রেখে সেচের সুবিধা নিশ্চিত করত। কিন্তু খালগুলো ভরাট হয়ে যাওয়া এবং নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে বর্তমানে বর্ষাকালে তীব্র বন্যা দেখা দেয় এবং শীতে পানির সংকট তৈরি হয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রায় নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে দিন দিন লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে, যা মানুষের জীবনযাত্রাকে হুমকির মুখে ফেলছে। খাওয়ার পানি পাওয়া যাচ্ছে না, কৃষিজমিতেও ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
খাল খননের কর্মসূচি চালু থাকলে খালগুলো মিষ্টি পানি ধরে রাখতে সাহায্য করত এবং নদীগুলো সঠিকভাবে খনন করা হলে লবণাক্ততা এতটা বিস্তার লাভ করত না। খাল খননের মাধ্যমে উপকূলীয় এলাকায় মিষ্টি পানির সংরক্ষণ শুধু কৃষিতে নয়, মাছ চাষেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলত।
৩.
জিয়ার খাল খনন কর্মসূচির ফলে শুষ্ক মৌসুমেও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং গ্রামীণ জনগণের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। খাদ্যের বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ শ্রমিক ও গরিব কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক ছিল। এ ছাড়া প্রচলিত প্রশাসনিক ব্যবস্থার বাইরে ‘voluntary participation’ আদর্শ তৈরি হয়েছিল, যেখানে স্থানীয় পুলিশ, বয়স্ক ও যুবকরা স্বেচ্ছায় খাল খননে অংশগ্রহণ করতেন। যেমন মানিকগঞ্জে দেখা গেছে, গ্রামের মানুষ নিজ উদ্যোগে হাতের হেলান দিয়ে খাল খনন করছিল।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খাল খনন কর্মসূচি ছিল এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। বর্তমানে অনেক খাল ভরাট হয়ে গেছে বা দখল হয়ে গেছে। খাল, জলাশয় দখলমুক্ত রাখতেও এই কর্মসূচি সহায়ক ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে কর্মসূচির ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলে। ফলে কিছু সাফল্য থাকলেও খাল খননের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বাধাগ্রস্ত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বন্যা ও খরা প্রতিরোধে এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে খাল ও নদীর খনন ও পুনঃখনন কর্মসূচি শুরু করা জরুরি। এই কর্মসূচি শুরু হলে দেশের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে, কৃষিকাজে পানি সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে এবং সুপেয় খাবারের পানির সহজলভ্যতা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি জিয়া মডেল আবার জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমাদের নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় দখলমুক্ত ও নাব্য রাখতে জনগণই এগিয়ে আসবে।
লেখক : অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়