বহু প্রবাসীকে ঠকানোর পাশাপাশি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ৯টি কম্পিউটার চুরির মামলায় মোস্তাউর রহমান (৪৯) নামের এক বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করেছে নিউইয়র্কের পুলিশ।
শুক্রবার বিকেলে জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউ এলাকার একটি দোকানে চুরি করা কম্পিউটারগুলো বিক্রির সময় ১০৭ পুলিশ স্টেশনের অফিসার তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির নাম ‘সাউথ এশিয়ান ফান্ড ফর এডুকেশন, স্কলারশিপ এ্যান্ড ট্রেনিং’ তথা স্যাফেস্ট। এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মাজেদা এ উদ্দিন জানান, কুইন্সের বাংলাদেশী অধ্যুষিত জ্যামাইকার ১৬৯-১৮ এ, দ্বিতীয় তলায় মোস্তাউর রহমানের মালিকানাধীন এমআরটি গ্রুপ এলএলসি’র অফিসের একটি কক্ষ আমি ভাড়া নেই গত জানুয়ারি মাসে। ৬ মে উদ্বোধন করেছি স্যাফেস্ট’র অফিস। সেখানে উদ্যমী প্রবাসীদের কম্পিউটার শেখানোর পাশাপাশি ভাষাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার পরামর্শও দেওয়া হয়। এমন অবস্থায় ঐ ভবনের মালিক মোস্তাউরের বিরুদ্ধে কুইন্স কোর্টে মামলা করেন ৮/৯ মাসের বকেয়া ভাড়া আদায়ের জন্য। এক পর্যায়ে ১৭ জুন আদালতের নির্দেশে নিউইয়র্ক সিটি মার্শাল রোনাল্ড ডব্লিউ পেজান্ট সেই ভবনে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ভবনের মালিক ছাড়া আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারবে না।
এ অবস্থায় মাজেদা ঘাবড়ে যান। কারণ, তার অফিসে ১৭টি কম্পিউটার, নগদ অর্থসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রয়েছে। নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা সত্বেও কেন তিনি মোস্তাউরের অপকর্মের ভিকটিম হলেন-এমন প্রশ্নে জর্জরিত হন। এমনি অবস্থায় মাজেদা জানতে পারেন যে, মার্শাল কর্তৃক ঐ ভবনে তালা লাগানোর আগেই মোস্তাউর সবকটি কম্পিউটার সরিয়ে ফেলেছেন।
১ জুলাই মাজেদা নিশ্চিত হন যে, অন্তত ৪টি কম্পিউটার জ্যামাইকার একটি দোকানে বিক্রির পাঁয়তারা চলছে। ঘটনাটি পুলিশের দৃষ্টিতে দেয়ার পর ৫ জুলাই অপরাহ্নে ঐ দোকানে অভিযানের সময় পুলিশ মোস্তাউরকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেছে। ঐ দোকানদার মো, নাসের পুলিশকে জানিয়েছেন যে, মোস্তাউর কম্পিউটারগুলো বিক্রির জন্যে এনেছেন। সাথে সাথে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। নিউইয়র্ক পুলিশের গণসংযোগ দফতরের ডেপুটি কমিশনার এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে, কুইন্সের শামসুল হক, নিজাম উদ্দিন, মো. শফিক, ফরিদা ইয়াসমীন, আব্দুল কাদেরসহ ১২ জন অভিযোগ করেছেন যে, তার প্রকৃত নাম হচ্ছে মো. মুস্তাকুর রহমান। অর্থাৎ একেক সময় একেক নাম ধারণ করেছেন লোকটি এবং তারা সকলেই প্রতারিত হয়েছেন। এরমধ্যে শামসুল হকের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ডলার। বিনিময়ে তাকে ওয়ার্ক পারমিট, সোস্যাল সিকিউরিটি নম্বর সংগ্রহ করে দেয়ার কথা। আরো ৯ হাজার ডলার চেয়েছেন কন্সট্রাকশন-ঠিকাদারের লাইসেন্স করে দেয়ার অঙ্গিকারে। কিন্তু তাকে ওয়ার্ক পারমিট সংগ্রহ করে দিতে পারেননি। সোস্যাল সিকিউরিটি নম্বর দিয়েছেন। সেটি নিয়ে হেলথ ইন্স্যুরেন্সের কার্ড করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলেন শামসুল হক। কারণ, সেটি একটি ভ’য়া নম্বর।
শামসুল হক ডক্যুমেন্টসহ অভিযোগ করেছেন, মুস্তাকুর নিজেকে ইমিগ্রেশনের অ্যাটর্নি পরিচয় দিয়ে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার বিস্তারিত আবেদনে সহায়তা করার অঙ্গিকার করেছেন। এ অঙ্গিকারে গত ১১ মার্চ ওই পরিমান অর্থ নেন। এখন শামসুল হক নিশ্চিত হয়েছেন যে, মুস্তাকুর অ্যাটর্নি নয়। মিথ্যা কথা বলেছেন।
অনুসন্ধানকালে জানা যায়, জ্যামাইকার মত ম্যানহাটানেও একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন মোস্তাউর। সেটির ভাড়া বাবদ দুটি চেক দেন। একটিও ভাঙাতে পারেননি ঐ কক্ষের মালিক। এ ধরনের বেশক'টি চেক দিয়েছেন নিউইয়র্কে বাংলা ভাষার পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপণের বিল বাবদ। প্রত্যেকেরই চেক বাউন্স হয় ঐ একাউন্টে কোন অর্থ না থাকায় অর্থাৎ পত্রিকাগুলোকে উল্টো জরিমানা দিতে হয়েছে।
অনুসন্ধানকালে আরো জানা গেছে, কুমিল্লার বুড়িচং –এর মুস্তাকুর ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের অকল্যান্ড সিটিতে ১৪৬০ ব্রডওয়েতে তার একটি অফিস ছিল। সেখানকার ভিজিটিং কার্ডে তাকে এমআরটি গ্রুপের এমডি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শুধু তাই নয়, শিক্ষাগত যোগ্যতার মধ্যে লেখা রয়েছে, কানাডা থেকে এমবিএ এবং এমএসএস করেছেন। ব্যবসা প্রশাসনে পিএইচডির ছাত্র ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে। মুস্তাকুরের কাছে প্রতারিতরা উল্লেখ করেছেন যে, সবকিছুই মিথ্যা। কারণ, তার চাল-চলন এবং কথাবার্তায় কোনভাবেই উচ্চ শিক্ষিত বলে মনে হয়নি।
সত্যিকার অর্থে তিনি ইমিগ্রেশনের অ্যাটর্নি কিনা জানতে চাইলে মোস্তাউর তথা মুস্তাকুর বলেন, ‘আমি অ্যাটর্নিশিপ করেছি কানাডায়।’ যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে আইনজীবী হিসেবে ব্যবসা করছেন-এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘নেটওয়ার্ক’-এ অ্যাটর্নিশিপ করেছি।’ অর্থাৎ উভয় তথ্যই সন্দেহের উর্দ্ধে নয়। নেটওয়ার্কে কোন ডিগ্রি অর্জনের বিধি নেই যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া, আইনজীবীর ব্যবসা করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন অঙ্গরাজ্যে বার কাউন্সিলের মেম্বার হতে হবে। লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মাজেদা এ উদ্দিন ৫ জুলাই রাতে জানান, মোস্তাউর তথা মুস্তাকুর ১২ জুলাই নিউইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যাবার বিমান টিকিট ক্রয় করেছেন। অর্থাৎ এখানকার প্রবাসীদের সর্বনাশ করে কেটে পড়তে চেয়েছিলেন। পুলিশে দেয়ায় সে পথ হয়তো বন্ধ হবে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল